
ছবি: সংগৃহীত
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা আর মতভেদের লম্বা শৃঙ্খল। বহুল আলোচিত এই সনদটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার একটি পথনকশা হিসেবে ঘোষিত হলেও এর আইনি কাঠামো, কার্যকারিতা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর বিভক্তি দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিভক্তি যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, এমনকি অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
রাজনৈতিক দলের অবস্থান
বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চূড়ান্ত ‘জুলাই সনদ’ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠায়। কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি দলকে শনিবার বিকাল ৫টার মধ্যে দুইজন করে প্রতিনিধির নাম দিতে বলা হয়। বিএনপিসহ ১৫টি দল প্রতিনিধি পাঠালেও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ১৮টি দল এখনো কোনো প্রতিনিধি দেয়নি। তাদের দাবি, আইনি ভিত্তি ছাড়া তারা সনদে স্বাক্ষর করতে রাজি নয়।
বিএনপি ইতোমধ্যে সনদে সইয়ের প্রক্রিয়ায় এগিয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে যোগ দেবেন। বিএনপির অবস্থান হলো—সংস্কার প্রয়োজন, তবে সেটা জনগণের স্বার্থে হতে হবে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুবিধার জন্য নয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, “সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি থাকতেই পারে। কিন্তু এগুলোর পেছনে যেন অন্য উদ্দেশ্য না থাকে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।”
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করছে। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা বিষয়টি নিয়ে ভেতরে আলোচনা করছি। অভ্যন্তরীণ পরামর্শ শেষে অবস্থান জানাব।”
এনসিপি আরও স্পষ্টভাবে আপত্তি তুলেছে। দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “শুধু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নির্বাচন করলে গণতন্ত্র টিকবে না। নির্বাচন-পরবর্তী শাসনব্যবস্থার নকশা যদি আমরা আগেভাগে নির্ধারণ না করি, তাহলে সেটি আমাদের কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর দেবে না। বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতর থেকে নতুন পথচলা সম্ভব নয়।”
ঐকমত্য কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একাধিক বৈঠক শেষে চূড়ান্ত সনদ প্রস্তুত করেছে। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ শনিবার এক আলোচনায় বলেন, “আমরা চাই না আরেকজন শেখ হাসিনা তৈরি হোক। রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া আগামী নির্বাচন অর্থবহ হবে না। ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে, জাতীয় নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে পড়বে।”
কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে আর প্রশ্ন না তুলেই সনদে সই করতে হবে। আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলাদা আলোচনা হবে, তবে এখনই সনদে স্বাক্ষর দেওয়া জরুরি। সূত্র বলছে, কমিশনের মেয়াদ ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি আরও ১৫ দিন বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কড়া অবস্থান
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও সনদ বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে যমুনায় কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর জরুরি, নইলে পুরো প্রক্রিয়া অচল হয়ে পড়বে।
চূড়ান্ত সনদের ভিন্নতা
খসড়া ও চূড়ান্ত সনদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা নিয়ে আপত্তি তুলছে অনেক দল। খসড়ায় উল্লেখ ছিল যে সনদের বৈধতা বা কর্তৃত্ব কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কিন্তু চূড়ান্ত সনদে বলা হয়েছে, স্বাক্ষরকারী দলগুলো প্রশ্ন তুলবে না। এছাড়া গণ-অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। খসড়ায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে একমাত্র ব্যাখ্যাকারী সংস্থা হিসেবে উল্লেখ থাকলেও চূড়ান্ত সনদ থেকে সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, “সনদের আইনি ভিত্তি দুর্বল হলে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা তৈরি হবে না। এটি যদি কেবল রাজনৈতিক চুক্তি হিসেবেই থেকে যায়, তবে আগামী নির্বাচনের পর বাস্তবায়ন নিয়ে আবার সংকট তৈরি হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসমিনা হক বলেন, “ঐকমত্য কমিশন ৭০টিরও বেশি বৈঠক করেছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত সনদে পরিবর্তন আনার ফলে দলেরা বিভ্রান্ত হয়েছে। রাজনৈতিক আস্থাহীনতা যদি দূর করা না যায়, তাহলে এই সনদ ব্যর্থ হয়ে যাবে।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পর যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা থেকে বের হওয়ার জন্য একটি রোডম্যাপ দরকার। সনদটি সেই রোডম্যাপ হতে পারে, তবে আইনগত বৈধতা নিশ্চিত করাই হবে প্রথম শর্ত।”
দীর্ঘ আলোচনার পটভূমি
এই সনদ প্রণয়নে মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩৫টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে ৭০টি বৈঠক হয়েছে। ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে, ১৪টি ক্ষেত্রে ভিন্নমত দেওয়া হয়েছে। খসড়ায় যেসব দলের নাম উল্লেখ ছিল, চূড়ান্ত সনদে শুধু সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে, যা নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জুলাই সনদ কেবল একটি কাগুজে চুক্তি নয়; এর সফলতা বা ব্যর্থতা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে না পারে, তবে নির্বাচনোত্তর সময়ে নতুন করে অস্থিরতা, সহিংসতা ও ক্ষমতার সংকট দেখা দিতে পারে।
একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই সনদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সমর্থন দুর্বল হয়ে পড়বে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ