
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নানা ধরনের জটিলতা, শুল্কহার পরিবর্তন, প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অফ টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (ওটেক্সা) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক। ২০২৪ সালের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির চাপের মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য বড় সাফল্য।
এ সময়ে একক মাস হিসেবে জুলাই মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যার আর্থিক পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প রফতানির সবচেয়ে বড় একক বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবছর প্রায় ৮ থেকে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক বাংলাদেশ এ বাজারে রফতানি করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাক রফতানি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
ওটেক্সার হিসাব অনুযায়ী, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বাংলাদেশের পোশাকের দাম সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে গড়ে ১ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ ক্রেতারা আগের তুলনায় কিছুটা বেশি মূল্য দিচ্ছে, যা সামগ্রিক আয় বাড়াতে সহায়ক হলেও প্রতিযোগিতামূলক চাপও তৈরি করছে।
বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। এটি বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ হলেও প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশে বেশি। ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
অন্যদিকে, শুল্ক জটিলতার কারণে চীনের তৈরি পোশাক রফতানি যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে ২১ শতাংশ। ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পেছনে অবস্থান করছে। ফলে এ খাতে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি তুলনামূলক শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশেষ করে কম মূল্যের পোশাক ও ক্যাজুয়াল ওয়্যার মার্কেটে নিজেদের জায়গা শক্ত করে রেখেছে। টি-শার্ট, পলো, জগার এবং স্লিপারের মতো পণ্যগুলোতে প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। বিজিএমইএর পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যেসব কম মূল্যের পণ্য রফতানি করছি, প্রতিযোগী দেশগুলো সেগুলো করে না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে এ বাজার আমাদের হাতে আছে এবং এখনো আমরা তা ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছি।’
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি মোহাম্মদ রফিক চৌধুরী বলেন, ‘চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত অতিরিক্ত শুল্ক বাংলাদেশের জন্য বড় একটি সুযোগ তৈরি করেছে। যদি আমরা এই সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে আগামীতে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়ানো সম্ভব।’
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের চেয়ারম্যান এস এম আবু তৈয়ব মনে করেন, সমন্বয় ছাড়া এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। তিনি বলেন, ‘সরকার, বিজিএমইএ এবং পোশাক মালিকদের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা এখন জরুরি। এনবিআর, বন্দর ও প্রণোদনা সংক্রান্ত জটিলতা দূর করার জন্য একটি সমন্বয় সেল গঠন করা উচিত। এর মাধ্যমে সমস্যাগুলো দ্রুত শনাক্ত ও সমাধান করা সম্ভব হবে।’
যদিও প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, তবে মার্কিন বাজারই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জটিল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের দাম বাড়লেও শুল্ক জটিলতা ও প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা এখনো বড় বাধা হয়ে আছে। বিশেষ করে অফডক শুল্ক, বন্দরের ধীরগতি, প্রণোদনা নীতির অস্পষ্টতা ও প্রশাসনিক অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রিতা রফতানিকারকদের সমস্যায় ফেলছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মোট প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সবচেয়ে বড়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদি বাংলাদেশ দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি, পণ্যের বহুমুখীকরণ, প্রযুক্তি ব্যবহারের আধুনিকায়ন এবং প্রশাসনিক জটিলতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক রফতানি আয় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বের অন্যতম বড় নিয়োগ খাত, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। মার্কিন বাজারে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলে এ খাত দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ