
ছবি: সংগৃহীত
সরকার দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠনের উদ্যোগ এবার চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই কার্যকর হতে যাচ্ছে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’, যার মাধ্যমে এনবিআরের বর্তমান কাঠামো ভেঙে নতুন দুটি পৃথক বিভাগ গঠন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই বড় পরিবর্তনের জন্য তিনটি আইন, একাধিক বিধি এবং ‘রুলস অব বিজনেস’ সংশোধনের পাশাপাশি নতুন জনবল কাঠামোও তৈরি করা হচ্ছে।
বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে চারটি বিভাগ— অর্থ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি), অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)। নতুন কাঠামোয় অর্থ বিভাগ, ইআরডি ও এফআইডি বহাল থাকলেও আইআরডির জায়গায় গঠিত হবে দুটি নতুন বিভাগ— রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। অর্থাৎ, বহু দশক ধরে প্রচলিত এনবিআর নামটি আর থাকছে না, চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পদ বিলুপ্ত হচ্ছে। এর পরিবর্তে দুই সচিবের নেতৃত্বে নতুন বিভাগগুলো পরিচালিত হবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আইন-কানুন সংশোধনের কাজ শেষ পর্যায়ে। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন হবে। তখন নতুন কাঠামোয় সচিব নিয়োগ দেওয়া হবে।”
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, আয়কর আইন এবং শুল্ক আইন—এই তিনটি মূল আইনেরই সংশোধনী আনা হচ্ছে। এনবিআরের তিনটি বিশেষ দল এ বিষয়ে কাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হয়ে যাবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, “অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের জন্য আইন, বিধি ও উৎস বিধি সংশোধন অত্যাবশ্যক। আমরা একসঙ্গে সব দিক নিয়ে কাজ করছি। দ্রুতই একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া পাওয়া যাবে।”
রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আলাদা করার বিষয়টি নতুন নয়। প্রায় দুই দশক ধরে বিশেষজ্ঞ মহল ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা এই সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তবে প্রতিবারই এনবিআরের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধে পদক্ষেপ থমকে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমবার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও সেটি পুরোপুরি সফল হয়নি।
চলতি বছরের জুন-জুলাই মাসে একদল এনবিআর কর্মকর্তা প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামে। তারা এই বিভাজনের তীব্র বিরোধিতা করে টানা কর্মসূচি চালান। এমনকি কয়েকজনকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়লে সরকার গত ২৯ জুন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে।
এই কমিটিই সমাধানের পথ বের করে এবং অধ্যাদেশের ১১টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেয়। পরবর্তীতে সেটি উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পায় গত ২১ আগস্ট।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এই কাঠামো পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেবে। তাদের বিশেষজ্ঞরা করনীতি, শুল্ক ব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে প্রস্তাবিত সংস্কারে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন।
নতুন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে কর আদায় প্রক্রিয়ায় নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম পৃথক হবে। রাজস্ব নীতি বিভাগ মূলত কর সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন, সংস্কার এবং বাজেট প্রস্তাব তৈরি করবে। অন্যদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ আইন বাস্তবায়ন, কর আদায়, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং মাঠপর্যায়ের তদারকি করবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয় আরও স্পষ্ট হবে। তবে কিছু অর্থনীতিবিদ সতর্ক করেছেন যে, কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি দক্ষ জনবল নিয়োগ ও প্রশাসনিক সংস্কার না হলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, “এটি নিঃসন্দেহে বড় সংস্কার। কিন্তু জনবল প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে শুধু কাঠামো বদলালেই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য পূরণ হবে না।”
সবকিছু ঠিকঠাক চললে আগামী ডিসেম্বরেই এনবিআর ভেঙে দুটি নতুন বিভাগ যাত্রা শুরু করবে। দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে