
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে মারাত্মক সংকটের মুখে পড়েছে। আগে যে খেলাপি ঋণ কেবলমাত্র কয়েকটি দুর্বল ও লুটপাটের শিকার ব্যাংকেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন সেটি প্রায় সব ব্যাংকেই ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন, জানুয়ারি-মার্চ ২০২৫’ থেকে উঠে এসেছে এক ভয়াবহ চিত্র—খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি, সম্পদের মানের অবনতি, প্রভিশন ঘাটতির বৃদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোর আয়-লাভের ধস।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে সম্পদের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। তবে প্রবৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। গত বছরের শেষ প্রান্তিক অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বরে সম্পদ বেড়েছিল ৪.১৯ শতাংশ হারে। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে তা নেমে এসেছে মাত্র ২.৪৩ শতাংশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশঙ্কা, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে, যা পুরো খাতকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০.২০ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবধানে মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪.১৩ শতাংশে। একই সময়ে প্রভিশন সংরক্ষণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে—ডিসেম্বরে ৫০.৭৫ শতাংশ থাকলেও মার্চে তা নেমে এসেছে ৩৭.৯৭ শতাংশে।
অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “খেলাপি ঋণ শুধু সংখ্যা বাড়াচ্ছে না, ব্যাংকগুলোর স্থিতিশীলতা ও আস্থা দুটোই নষ্ট করছে। যখন কোনো ব্যাংক প্রভিশন যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারে না, তখন তাদের ভবিষ্যৎ দায় মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে আমানতকারীর অর্থও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।”
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, গত ডিসেম্বরে ব্যাংক খাত সম্পদ ও মূলধন থেকে মুনাফা অর্জন করতে পেরেছিল। কিন্তু মার্চে এসে সেই জায়গায় লোকসান দেখা দিয়েছে। সম্পদ থেকে লোকসান হয়েছে ০.১৮ শতাংশ এবং মূলধন থেকে লোকসান হয়েছে ৩.৯৯ শতাংশ। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম মন্তব্য করেন, “এখনকার ব্যাংক খাত একটি ডুবে যাওয়া জাহাজের মতো। লুটপাট, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছেই। আর এই বোঝা বহন করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো মুনাফার জায়গায় লোকসানে পড়ছে। আগামীতে মূলধনের ঘাটতি আরও প্রকট হয়ে উঠবে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর মূলধন কিছুটা বেড়েছে। ডিসেম্বরে এই হার ছিল ৩.৬৬ শতাংশ, মার্চে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৭৪ শতাংশে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করেছে, খেলাপি ঋণের বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে মূলধন সংরক্ষণের হার আবারও কমে গিয়ে ৩.৩৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। বিশেষত যদি শীর্ষ দুই ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয়ে যায়, তবে পুরো খাতেই বড় ধরনের ধাক্কা আসবে।
আগে খেলাপি ঋণ মূলত কয়েকটি ব্যাংকে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে প্রায় সব ব্যাংকেই। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মোট খেলাপি ঋণের ৫১.৬৫ শতাংশ ছিল শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকে। মার্চে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭.৯৪ শতাংশে। একই সময়ে শীর্ষ ১০ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের অংশ ৭৪.৮৭ শতাংশ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ৭১.৩৮ শতাংশে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ আর কেন্দ্রীয় নয়, বরং সার্বিকভাবে সব ব্যাংকেই বিস্তার লাভ করছে।
ড. সেলিম রায়হান এ প্রসঙ্গে বলেন, “খেলাপি ঋণ কেন্দ্রীভূত না থেকে ছড়িয়ে পড়া মানে হলো ব্যাংক খাতের সব স্তরেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এটা অনেক বেশি বিপজ্জনক। কারণ এতে কোনো ব্যাংকই নিরাপদ থাকে না।”
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ২৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫ শতাংশের নিচে। কিন্তু ২০২৫ সালের মার্চে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫টিতে। অর্থাৎ ১১টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে। এছাড়া, ৫ থেকে ১৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংকের সংখ্যা ডিসেম্বরে ছিল ১৬টি, মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ২৩টি। আর ৫০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংক ডিসেম্বরে ছিল ৮টি, মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০টিতে।
প্রতিবেদনের সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবে দেওয়া ঋণগুলো এখন পরিশোধ না হয়ে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞ ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, “পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে যে হারে লুটপাট হয়েছে, তার দায় এখন পুরো ব্যাংক খাত বহন করছে। যদি কার্যকর সংস্কার না আনা যায়, তবে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে এবং এর সঙ্গে আমানতকারীদের আস্থাও ভেঙে পড়বে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করেছে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংক খাত আগামীতে আরও বড় সংকটে পড়বে। খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকলে জামানতের পরিমাণ কমে যাবে, ফলে ঝুঁকি বেড়ে যাবে। আর মূলধন পর্যাপ্ততা নেমে গেলে ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “ব্যাংক খাতের এ সংকট মোকাবিলায় দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কেবল নীতি প্রণয়ন নয়, কার্যকর বাস্তবায়ন দরকার। না হলে অর্থনীতি জুড়ে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।”
এক কথায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত। খেলাপি ঋণ ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে, সম্পদের মান কমছে, প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে এবং মুনাফা লোকসানে রূপ নিচ্ছে। এখনই কাঠামোগত সংস্কার না হলে পুরো অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়তে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ