
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলি সেনাবাহিনী নতুন করে গাজা সিটি পুরোপুরি খালি করার নির্দেশ দিয়েছে। প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনির আবাস এ শহরটিকে লক্ষ্য করে এবার সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) ইসরাইলি সেনাদের আরবি মুখপাত্র আভিচায় আদরাই এক ঘোষণায় গাজার বাসিন্দাদের সরাসরি আহ্বান জানান— অবিলম্বে এলাকা ছেড়ে দক্ষিণের মানবিক অঞ্চলে চলে যেতে। একই দিনে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভিডিও বার্তায় জানিয়ে দিয়েছেন, এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তা কেবল শুরু মাত্র।
গাজায় নতুন হামলার কৌশল
গত ২৪ ঘণ্টায় গাজা সিটিতে অন্তত ৫০টি ভবন ধ্বংস করেছে ইসরাইলি সেনারা। এবার তারা ব্যবহার করছে নতুন যুদ্ধকৌশল— বিস্ফোরকবাহী রোবট। সেনাদের দাবি, এই রোবটের মাধ্যমে লক্ষ্যভেদ আরও নির্ভুল ও দ্রুত হচ্ছে। শতাধিক ভবন আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বহু এলাকা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আভিচায় আদরাই বলেন, “গাজার উত্তরাঞ্চল ও গাজা সিটির সব বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আইডিএফ (ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) হামাসকে নির্মূল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। গাজা সিটিতে এমন এক ভয়াবহ শক্তি নিয়ে আমরা অভিযান চালাব, যেমনটি পুরো উপত্যকাজুড়ে করেছি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আপনাদের নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে আল-মাওয়াসির মানবিক অঞ্চলের দিকে চলে যান। সেখানে আমরা আপনাদের জন্য নিরাপদ করিডোর তৈরি করেছি।”
লিফলেট ফেলে সতর্কবার্তা
এর আগে ইসরাইলি বিমান থেকে গাজা সিটির ওপর অসংখ্য লিফলেট ফেলা হয়। সেখানে মানচিত্রে স্পষ্ট করে দেখানো হয়, কোন পথে মানুষকে সরতে হবে। গাজার পশ্চিম উপকূলে সরতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব লিফলেটে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়: “এলাকা ছেড়ে যান, নইলে জীবন ঝুঁকিতে পড়বে।”
নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারি
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার বার্তায় আরও আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, “আমরা গত দুই দিনে গাজার ৫০টি টাওয়ার ধ্বংস করেছি। এটা কেবল শুরু। গাজার প্রত্যেক বাসিন্দাকে সতর্ক করছি— সময় নষ্ট করবেন না, এখনই সরে যান।”
তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, গাজা সিটিকে তারা হামাসের শেষ ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাই এই শহরে প্রবল স্থল অভিযান চালানো হবে।
গাজাবাসীর আতঙ্ক ও অসহায়ত্ব
ইসরাইলের এ হুঁশকিতে গাজা সিটির বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ দক্ষিণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তবে বেশিরভাগ মানুষই হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের বক্তব্য, “আমরা আর কোথায় যাব? গাজার উত্তর, দক্ষিণ— কোথাও তো নিরাপদ না। আমাদের বাড়িঘর ইতোমধ্যেই একাধিকবার ছেড়ে যেতে হয়েছে। এবার আমরা থাকব, যেটা হওয়ার হবে।”
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে যুদ্ধ শুরুর পর এ পর্যন্ত গাজার মানুষ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। কখনও উত্তর থেকে দক্ষিণে, আবার কখনও দক্ষিণ থেকে উপকূলে সরতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিবারই তারা নতুন সংকটে পড়েছেন। এখনকার পরিস্থিতিতে মানবিক বিপর্যয় আরও তীব্র আকার নিয়েছে, জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই একে “দুর্ভিক্ষ-সদৃশ সংকট” বলে আখ্যা দিয়েছে।
মানবিক বিপর্যয় চরমে
খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের তীব্র ঘাটতির মধ্যে রয়েছে গাজা। আন্তর্জাতিক সাহায্য সীমিত, সীমান্ত দিয়ে ত্রাণ ঢুকতে পারছে না যথেষ্ট পরিমাণে। শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে শয্যা নেই, ওষুধ নেই। বাস্তুচ্যুত মানুষেরা স্কুল, মসজিদ কিংবা খোলা মাঠে আশ্রয় নিচ্ছেন।
গাজা সিটির বাসিন্দা হানান নামের এক নারী বলেন, “আমরা বারবার ঘর ছেড়েছি। কিন্তু কোথাও শান্তি নেই। প্রতিবারই আমাদের পিছু নেয় বোমা। এখন আমরা ক্লান্ত, কোথাও যাব না।”
স্থল অভিযান আসন্ন
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ছাড়াও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “হামাস যদি আত্মসমর্পণ না করে এবং হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি না দেয়, তবে আইডিএফ প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের মতো অভিযান চালাবে।”
এ বক্তব্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইসরাইল খুব শিগগিরই গাজা সিটিতে স্থল অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। এর ফলে কয়েক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে চলতে পারে রক্তক্ষয়ী সংঘাত।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মহল ইসরাইলের এ নতুন নির্দেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার বলছে, গাজার মানুষকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরানোর ফলে প্রকৃত কোনো নিরাপত্তা মিলছে না। বরং সংকট আরও ভয়াবহ হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হলেও ইসরাইল তা প্রত্যাখ্যান করেছে। নেতানিয়াহুর সরকারের দাবি, হামাস পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।
ফলে গাজা সিটির প্রায় ১০ লাখ বাসিন্দা এখন দিশাহীন। কেউ নিরাপদ স্থানে যেতে চাইছেন, কেউ আবার সর্বস্ব হারানোর পরও নিজের ঘর ছেড়ে যেতে রাজি নন। আন্তর্জাতিক মহল বলছে, যদি স্থল অভিযান শুরু হয়, তবে এটাই হবে যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ