
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য। আগস্ট মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ধারা থামেনি। ফলে নিম্ন ও স্থির আয়ের মানুষের জন্য বাজারে স্বস্তি আসেনি।
বিবিএস জানায়, আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। এর আগের মাস জুলাইয়ে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাসিক তুলনায় ০.২৬ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে সার্বিক মূল্যস্ফীতি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকা, আমদানিকৃত পণ্যে কিছুটা শিথিলতা আসা এবং স্থানীয় বাজারে খাদ্যবহির্ভূত কিছু পণ্যের দাম কমায় সামগ্রিকভাবে এই হ্রাস ঘটেছে। তবে এ হার এখনো অনেক বেশি, কারণ সরকারের লক্ষ্য ছিল ৬ শতাংশের আশপাশে নামিয়ে আনা।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যবহির্ভূত খাতে আগস্টে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। জুলাইয়ে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা আগস্টে নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশে। অর্থাৎ এই খাতে ০.৪৮ শতাংশ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে।
কিন্তু খাদ্যপণ্যে ভিন্ন চিত্র। জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশে। সামান্য এই বৃদ্ধিই বাজারে চাপ তৈরি করেছে। বিশেষ করে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, ডিম, সবজি এবং মাছের দাম নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর বা শান্তিনগরের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ ক্রমবর্ধমান খাদ্যদামে হতাশ। অনেকেই আগের মতো বাজার করতে পারছেন না। অনেক পরিবারকে এখন খাবারের তালিকা ছোট করতে হচ্ছে।
মিরপুরে মুদি দোকানে কেনাকাটা করতে আসা দিনমজুর সাইফুল ইসলাম বলেন, “আগে এক কেজি ডাল কিনতাম, এখন আধা কেজি কিনতে হয়। বাজারে গেলে হিসাব মিলানোই কঠিন হয়ে যায়।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খাদ্যদ্রব্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি সরাসরি নিম্ন আয়ের মানুষকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করে। কারণ তাদের আয়ের বড় অংশই খাদ্যে ব্যয় করতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও খাদ্যে চাপ অব্যাহত থাকাটা খুবই উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো সম্ভব হবে না। সরকারকে আমদানি নীতি সহজ করা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।”
অন্যদিকে নীতি বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, “আমাদের মূল্যস্ফীতির হার এখনো উচ্চ পর্যায়ে আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো অস্থিরতা দেখা দিলে বা জ্বালানির দাম বাড়লে তা সঙ্গে সঙ্গেই ঘরোয়া বাজারে চাপ সৃষ্টি করবে।”
সরকার অবশ্য কিছুটা স্বস্তির সুরেই কথা বলছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে, যা ইতিবাচক। সরকারের লক্ষ্য চলতি অর্থবছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। এজন্য আমদানি বিকল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষি খাতে প্রণোদনা এবং পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলা জোরদার করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, সামনের দিনগুলোতে ডলার সংকট, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ এবং বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা যদি বাড়ে, তাহলে মূল্যস্ফীতি আবারও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। বিশেষ করে রমজান বা বড় কোনো উৎসব সামনে এলে খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা বাড়ে, যা দামের ওপর প্রভাব ফেলে।
সব মিলিয়ে আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনে বড় কোনো স্বস্তি আসেনি। অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে এখনই আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ