
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দেড় দশকে এক বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশেষ করে মাথাপিছু জিডিপি বা গড় নাগরিকের জন্য উৎপাদিত সম্পদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০১০ সালে যেখানে একজন বাংলাদেশির মাথাপিছু জিডিপি ছিল মাত্র ৮৮২ মার্কিন ডলার, সেখানে ২০২৪ সালের হিসাবে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬২৫ ডলারে। অর্থাৎ ১৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এই উন্নতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ সারির দেশগুলোর পেছনে অবস্থান করছে। সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও ভারত। তবে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে পাকিস্তান, নেপাল এবং আফগানিস্তানের তুলনায়।
এডিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে মালদ্বীপ। দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ১১ হাজার ডলারের বেশি, যা পুরো অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক গুণ বেশি। পর্যটনভিত্তিক অর্থনীতির কারণে মালদ্বীপ দীর্ঘদিন ধরেই মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, যাদের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৪ হাজার ৫১৬ ডলার। ভুটানও উন্নত অবস্থানে আছে—দেশটির মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৪ হাজার ডলার। ভারত রয়েছে চতুর্থ স্থানে, মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৮০০ ডলার। আর বাংলাদেশ ২ হাজার ৬২৫ ডলার নিয়ে পঞ্চম স্থানে।
বাংলাদেশের পর রয়েছে পাকিস্তান, যেখানে মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৫৮২ ডলার। নেপালের মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৪৩৪ ডলার এবং তালিকার একেবারে নিচে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, যেখানে মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৪০০ ডলারের কিছু বেশি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, মাথাপিছু জিডিপি কোনো ব্যক্তির প্রকৃত আয়কে সরাসরি প্রতিফলিত করে না। এটি একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে নির্ণয় করা হয়। অর্থাৎ দেশের সামগ্রিক উৎপাদন ক্ষমতা বা সম্পদ তৈরির গড় চিত্রই মাথাপিছু জিডিপির মাধ্যমে ধরা হয়।
এই সূচক যত বাড়ে, তত বোঝায় যে দেশের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং গড়ে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বেশি সম্পদ তৈরি হচ্ছে। তবে এর মানে এই নয় যে সবাই সমানভাবে সেই সুফল পাচ্ছেন। প্রকৃত আয় বণ্টন, দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা—এসব বিষয়ও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দেড় দশকে যে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে, তার প্রতিফলনই এই মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধিতে দেখা যায়। ২০১০ সালে যেখানে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার নিম্ন সারিতে ছিল, এখন সেটি মধ্যম অবস্থানে উঠে এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধি, প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিকতা, কৃষি খাতের স্থিতিশীলতা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাংলাদেশকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে দেড় দশকে গার্মেন্টস রপ্তানি তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে জিডিপি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
যদিও মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের সামনে এখনও বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শিল্প খাতে বৈচিত্র্য না আসা, রপ্তানিতে পোশাকনির্ভরতা, বৈদেশিক ঋণের চাপ, মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের সংকট—এসবই ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক সংকেত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু মাথাপিছু জিডিপি বাড়ানোই যথেষ্ট নয়; বরং সেই উন্নতি যেন মানুষের জীবনমানেও প্রতিফলিত হয়, তা নিশ্চিত করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতিবিদরা আশাবাদী যে সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে বাংলাদেশ আগামী এক দশকের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আরও উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হবে। শিল্পায়নে বৈচিত্র্য আনা, কৃষির আধুনিকায়ন, ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসার, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো—এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি আরও দ্রুত বাড়তে পারে।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে এখন একটি মধ্যম সারির খেলোয়াড়। যদিও এখনো মালদ্বীপ বা শ্রীলঙ্কার সমকক্ষ নয়, তবে পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তানকে পিছনে ফেলতে পারা বাংলাদেশের অগ্রগতিরই প্রমাণ। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এটি একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুফল ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এবং সামগ্রিক জীবনমান উন্নয়নের পথে দেশ এগোচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ