
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় আবারও ভয়াবহ রক্তপাত ঘটিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) ভোর থেকে শুরু হওয়া বিমান হামলায় মাত্র একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৭ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬৪ হাজার ৩৬৮-এ পৌঁছেছে এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬২ হাজার ৩৬৭ জন। এই দীর্ঘ সময় ধরে চলমান গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে গাজার আকাশ প্রতিদিনই রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে।
শনিবার ভোরে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গাজা শহরের উত্তরাংশে অবস্থিত বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর আবাসিক ভবনে সরাসরি হামলা চালায়। স্থানীয়রা জানান, হামলার আগে কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। ফলে ঘুমন্ত অবস্থায় বহু নারী, শিশু ও বৃদ্ধ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান। উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, পুরো ভবনগুলো মুহূর্তেই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে অসংখ্য মানুষ জীবিত বা মৃত অবস্থায় চাপা পড়ে আছেন।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করলেও গাজায় সহিংসতা থামেনি। গাজার হাসপাতালগুলো এখন আর নতুন রোগী নিতে পারছে না। চিকিৎসা সরঞ্জামের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভাবে বহু হাসপাতাল বন্ধ হওয়ার পথে। পানির অভাবে কলেরা ও অন্যান্য সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে লাখ লাখ মানুষ স্কুল, মসজিদ ও খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবুও তারা নিরাপদ নন। ইসরায়েলি হামলায় এসব আশ্রয়কেন্দ্রও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
গত ১৮ মার্চ থেকে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ভেঙে পুনরায় আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল। এর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১১ হাজার ৭৬৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আরও প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এই সময়ের আক্রমণগুলো আরও ভয়াবহ, যেখানে মূল টার্গেট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে আবাসিক ভবন, হাসপাতাল, বাজার ও আশ্রয়কেন্দ্রে হামলা চালাচ্ছে।
গাজার বর্তমান যুদ্ধের সূচনা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক আক্রমণকে কেন্দ্র করে। ওই ঘটনায় ইসরায়েলে ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হয় এবং প্রায় ২০০ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর থেকে ইসরায়েলি প্রতিশোধমূলক হামলায় গাজা পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শিশু, নারী ও বৃদ্ধই সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছেন।
এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। গত নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) গাজার যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। একইসঙ্গে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) মামলা চলছে। তবে আন্তর্জাতিক নিন্দা বা আইনি প্রক্রিয়া কোনোভাবেই ইসরায়েলের আগ্রাসন থামাতে পারেনি।
ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে সন্তান হারানো মায়ের কান্না, খাবার ও পানির জন্য লাইনে দাঁড়ানো শিশুর আর্তনাদ এবং আহতদের অসহায় চিৎকারে আজ গাজা পরিণত হয়েছে এক বিশাল কবরস্থানে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিনের হামলাতেই বহু পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যাদের কোনো খোঁজ নেই, তাদের নাম কেবল তালিকায় যোগ হচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ হলেও বড় শক্তিগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান প্রশ্নের মুখে। জাতিসংঘ বারবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো ইসরায়েলকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে, যা এই আগ্রাসনকে আরও দীর্ঘায়িত করছে বলে অভিযোগ উঠছে।
সবশেষে বলা যায়, গাজা উপত্যকায় শনিবারের এই হত্যাযজ্ঞ কেবল একটি দিনের ঘটনা হলেও এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো—ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আন্তর্জাতিক চাপ বা আদালতের রায় নয়, বরং বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপই পারে এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় থামাতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ