
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ২১টি বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (অফডক বা আইসিডি) নতুন ট্যারিফ কার্যকর করায় আমদানি–রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, কোনো আলোচনা ছাড়াই ৩০ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি ট্যারিফ আদায় শুরু করেছে এসব অফডক। এতে রপ্তানিকারক, আমদানিকারক ও শিপিং এজেন্টরা সরাসরি চাপের মুখে পড়েছেন। বন্দর ব্যবহারকারীদের আশঙ্কা, বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত খরচ ব্যবসার গতি কমিয়ে দেবে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পোশাক খাতকে দুর্বল করে তুলবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, “ট্যারিফ ৬৩ শতাংশ বাড়ানোয় পরিবহন খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে। ব্যবসায়িক খাতের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানো হলো। কোনো আলোচনার মাধ্যমে নয়, একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ব্যবসাবান্ধব নীতি নয়।”
বিজিএমইএর একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “রপ্তানি বাজারে যেখানে প্রতিযোগিতা তীব্র, সেখানে কৃত্রিমভাবে খরচ বাড়ানো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় গার্মেন্টস খাতের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াবে।”
২০১৬ সালের আইসিডি নীতিমালা অনুযায়ী, নতুন ট্যারিফ কার্যকরের আগে বিকডার (বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন) বাধ্যবাধকতা রয়েছে শিপার, কনসাইনি, শিপিং এজেন্ট, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবি, এই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, “আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার বাইরে কোনো ট্যারিফ কার্যকর হওয়া উচিত নয়। বিষয়টি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। দ্রুত সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করা হবে।”
বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “গত নয় বছরে ট্যারিফ নির্ধারণে কোনো কার্যকর কমিটি কাজ করেনি। ২০২১ সালে জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে ট্যারিফ ২৩ শতাংশ সমন্বয় করা হয়েছিল। এবার শ্রমিক-মজুরি বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ, মূল্যস্ফীতি এবং টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি–সব মিলিয়ে নতুন ট্যারিফ সমন্বয় ছাড়া ডিপো চালানো সম্ভব হচ্ছিল না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদেরও টিকে থাকতে হবে। খরচ না মেটাতে পারলে ডিপোগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে, তখন আমদানি–রফতানি আরও বড় সংকটে পড়বে।”
পরিবহন ও লজিস্টিক খাতের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুল মতিন বলেন, “অফডকগুলো আমদানি–রফতানি বাণিজ্যের জন্য অপরিহার্য। তবে নীতিগত প্রক্রিয়া ছাড়া ট্যারিফ বাড়ানো দীর্ঘমেয়াদে অস্থিরতা তৈরি করবে। সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি যৌক্তিক সমাধান জরুরি।”
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজুর রহমান মনে করেন, “বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। অতিরিক্ত খরচ এ খাতকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেবে। সরকারকে বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দ্রুত মধ্যস্থতা করতে হবে।”
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক আমিনুল হক বলেন, “অতিরিক্ত খরচ ব্যবসায়ীরা মানবে না। আলোচনার বাইরে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে আমদানি–রফতানি বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।”
জটিলতা নিরসনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে এবং দ্রুত স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সচিব ওমর ফারুক বলেন, “বন্দরের কার্যক্রম সচল রাখা সবার স্বার্থে জরুরি। সহনশীল ও ব্যবসাবান্ধব সমাধান না আসা পর্যন্ত এ সমস্যা আরও প্রকট হবে।”
১৯৯৬ সালে কেবল খালি কনটেইনার উঠানামার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা অফডকগুলো এখন চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমানে এসব ডিপো থেকে আমদানিকৃত ৬৫ ধরনের পণ্য ডেলিভারির অনুমতি রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ ৭৭ হাজার রপ্তানি কনটেইনার এবং ২ লাখ ৬৫ হাজার আমদানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে থাকে ২১টি বেসরকারি অফডক। আমদানি–রফতানি বাণিজ্যের গতি বাড়াতে এবং বন্দরের চাপ কমাতে অফডকগুলোর কোনো বিকল্প নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সব মিলিয়ে, চট্টগ্রাম বন্দরের অফডক ট্যারিফ বাড়ানোকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া এই জটিলতা কেবল ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, পুরো দেশের আমদানি–রফতানি খাতের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অংশীজনরা বলছেন, আলোচনাভিত্তিক ও বাস্তবতানির্ভর সমাধান ছাড়া এ অচলাবস্থা কাটানো সম্ভব নয়।
বাংলাবার্তা/এসজে