
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এক ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। একসময় গ্রাহকের আমানতে ভর করে দাঁড়ানো বেসরকারি পাঁচটি ব্যাংক—এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক—এখন কার্যত গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। গ্রাহক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত সবাই আস্থাহীনতা ও হতাশার দোলাচলে দিন কাটাচ্ছেন।
রাজধানীর মতিঝিল, নয়াপল্টন কিংবা জেলা শহরের শাখাগুলোতে প্রতিদিনই টাকা তুলতে আসেন ২০-৩০ জন গ্রাহক। কিন্তু সবার হাতে নিরাশা ছাড়া কিছুই ওঠে না। কর্মকর্তারা চুপচাপ বসে থাকেন, কারও অনুরোধ শুনে মাথা নেড়ে উত্তর দেন, আবার কারও চোখের জল ফেলার দৃশ্য এড়িয়ে যেতে পারেন না।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের নয়াপল্টন শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মার্জারের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের আর্থিক সহায়তা বন্ধ রেখেছে। গত এক মাস ধরে কাউকে কোনো টাকা দিতে পারছি না। এমনকি আমাদের নিজের বেতনও তোলা যাচ্ছে না।”
একজন গ্রাহক বাবার বিদেশে চিকিৎসার জন্য টাকা তুলতে গিয়ে বারবার ফিরে আসেন খালি হাতে। ব্যাংক থেকে সামান্য কিছু টাকা দিলেও তা দিয়ে চিকিৎসা সম্ভব নয়। অন্য একজন গ্রাহকের হৃদরোগের অপারেশনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১১ লাখ টাকা। অনেক চেষ্টার পর ব্যাংক মাত্র ২ লাখ টাকা দিতে পেরেছে।
সাতক্ষীরায় এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে ছিল ৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা। কিন্তু তাকে জানানো হয়েছে, সপ্তাহে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা তোলা যাবে। স্কুলশিক্ষক আবদুল কাদের টানা ১৮ বার ব্যাংকে ঘুরেও নিজের জমানো এক লাখ ২৭ হাজার টাকার এক হাজার টাকাও তুলতে পারেননি।
গ্রাহক সাদ্দাম হোসেন বলেন, “সংকটের দিনে কাজে লাগবে ভেবেই ব্যাংকে টাকা রেখেছিলাম। এখন নিজের টাকার জন্য ভিক্ষা করতে হচ্ছে। ধার-দেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে।”
শুধু গ্রাহক নন, ব্যাংকের কর্মকর্তারাও একই সমস্যায় ভুগছেন। একজন কর্মকর্তা জানান, তার মাসিক বেতন ৮০ হাজার টাকা হলেও বাস্তবে তিনি এক হাজার টাকাও তুলতে পারছেন না। অন্য ব্যাংকের এটিএম থেকে টাকা তুললে প্রতিবার ১৫ টাকা ফি কাটা হয়। তিনি বলেন, “সংসার চালাতে এখন বন্ধুবান্ধবের কাছে ঋণ চাইতে হচ্ছে।”
আরেকজন কর্মকর্তা যোগ করেন, “বেতন অ্যাকাউন্টে জমা হয়, কিন্তু ক্যাশ নেই। সংসার খরচ, সন্তানদের পড়ালেখা, বাসাভাড়া—সবই এখন অচল হয়ে গেছে।”
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের (৫ আগস্ট ২০২৪) পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বোর্ড ভেঙে দেয় এবং ৫২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেয়। শুরুতে কিছুটা স্বস্তি এলেও এখন আবার সংকট ঘনীভূত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে—
-
পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানত: ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা
-
বিতরণ করা ঋণ: ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা
-
খেলাপি ঋণ: ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা (৭৭ শতাংশ)
-
মূলধন ঘাটতি: ৪৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা
-
গ্রাহক সংখ্যা: ৯২ লাখের বেশি
-
কর্মকর্তা-কর্মচারী: ১৫ হাজারের বেশি
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে। পুনর্গঠনের জন্য কমপক্ষে ৩৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গ্রাহকের আমানত শতভাগ ফেরত দেওয়া হবে। ‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ–২০২৫’ খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “শিগগির একীভূতকরণ কার্যকর হবে। পাঁচ ব্যাংক মিলে একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠন করা হবে। সরকার আর্থিক সহায়তা দেবে এবং পরবর্তীতে লাভসহ সেই অর্থ ফেরত নিয়ে যাবে।”
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, “দীর্ঘদিনের অনিয়ম, ঋণ কেলেঙ্কারি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ব্যাংক খাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন গ্রাহকরা আতঙ্কিত, ব্যাংকাররা হতাশ, আর পুরো অর্থনীতি অচল হওয়ার পথে।”
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি মন্তব্য করেন, “কেবল তারল্য সহায়তা দিয়ে এই ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। দ্রুত মার্জার ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল আরও আগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া।”
অন্যদিকে সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, “মার্জার কার্যকর হলেও আস্থা ফিরতে সময় লাগবে। গ্রাহকরা এখন শঙ্কিত, তাদের মনে হচ্ছে—নিজের টাকা আর কোনোদিন হয়তো ফেরত পাবেন না।”
ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মো. হুমায়ুন কবির বলেন, “আমরা বহু প্রতিষ্ঠানের এফডিআরের টাকা ফেরত দিতে পারছি না। ছোট ছোট আমানতকারীর টাকাও আটকে আছে। নতুন আমানত আসছে না, পুরোনো বিনিয়োগের রিকভারি নেই। সব মিলিয়ে ভাঙা ঘর পাহারা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি।”
তবে তিনি দাবি করেন, কর্মকর্তারা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন এবং বিকল্প স্কিমে টাকা তুলতে পারছেন। তবে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের এই গভীর সংকট কেবল গ্রাহকের জন্য নয়, পুরো অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। গ্রাহকের জমানো টাকা যখন ফেরত পাওয়া যায় না, তখন ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা ধ্বংস হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দ্রুত একীভূতকরণ, কঠোর শাসন ও দুর্নীতিবাজদের বিচারের মাধ্যমেই কেবল এই আস্থা কিছুটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অন্যথায় ব্যাংক খাতের দুর্বলতা আরও বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটে রূপ নিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ