
ছবি: সংগৃহীত
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত বিমান ও স্থল হামলায় মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত অন্তত ২ হাজার ৭০০ পরিবার সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে—অর্থাৎ এসব পরিবারের একজন সদস্যও জীবিত নেই। বিবৃতিতে চলমান এই মানবিক বিপর্যয়কে জাতিগত নির্মূল হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তাকে ‘লজ্জাজনক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
তুরস্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড জানিয়েছে, গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলি বাহিনী গাজায় নিরবচ্ছিন্ন বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে উপত্যকার প্রায় ৯০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ আনুমানিক ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
ইসরাইলি হামলায় ভেঙে পড়েছে ৩৮টি হাসপাতাল, ৮৩৩টি মসজিদ এবং দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ায় আহতদের চিকিৎসা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একইভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ায় শিশুদের ভবিষ্যৎ ও সামাজিক জীবনের ভিত্তি নড়ে গেছে।
আল জাজিরার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনিবার রাত থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত গাজায় নতুন করে আরও ৬৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কেবল গাজা শহরেই প্রাণ হারিয়েছেন ৪৫ জন। শহরটি দখল করার লক্ষ্য নিয়ে ইসরাইলি সেনারা ব্যাপক সামরিক অভিযান চালাচ্ছে এবং জোর করে সাধারণ মানুষকে দক্ষিণে সরে যেতে বাধ্য করছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে অন্তত ৬৪ হাজার ৩৬৮ ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬২ হাজার ৩৬৭ জন। নিহতদের মধ্যে ২০ হাজারের বেশি শিশু এবং হাজার হাজার নারী রয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এ ধরনের শিশু হত্যাযজ্ঞ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনো দেখা যায়নি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অবরোধ ও অব্যাহত হামলার কারণে খাদ্য সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ইসরাইলি অবরোধ-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। শনিবারের হিসাব অনুযায়ী, অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮২ জনে, যার মধ্যে ১৩৫ জন শিশু। গত একদিনেই দুর্ভিক্ষে মারা গেছেন আরও ৬ ফিলিস্তিনি। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় এখন “মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ” চলছে, যা পরিকল্পিতভাবে চালানো হচ্ছে।
গাজার রাজধানী শহরকে অচল করে দিতে ইসরাইলি বাহিনী একের পর এক উঁচু আবাসিক টাওয়ার ধ্বংস করছে। মুশতাহা টাওয়ার ধ্বংস করার পর শনিবার স্থানীয় সময় আল–সুসি আবাসিক টাওয়ারও উড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব হামলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গালান্ত কাৎজ ঘোষণা দেন, এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
তেল আবিবের দাবি, এসব ভবন হামাসের নজরদারির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল। তবে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি তারা। স্থানীয়রা বলছে, আবাসিক ভবনগুলোতে সাধারণ ফিলিস্তিনি পরিবারই বসবাস করত।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষায়, চলমান হামলা স্পষ্টত জাতিগত নির্মূল হলেও বিশ্বশক্তিগুলো চোখ বন্ধ করে আছে। জাতিসংঘের জরুরি বৈঠক থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবাদ—সবই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে, বাস্তবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আদালত, মানবাধিকার সংগঠন ও আরব লীগের তৎপরতাও কার্যত ফলপ্রসূ হয়নি। গাজাবাসী বলছেন, আন্তর্জাতিক নীরবতা ইসরাইলের আগ্রাসনকে উৎসাহ দিচ্ছে।
ইসরাইলের সবচেয়ে বড় সমর্থক হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র এখনো কার্যত তেল আবিবের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সাম্প্রতিক মন্তব্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন হামাসের সঙ্গে কিছু ‘গঠনমূলক আলোচনা’ চালাচ্ছে। তিনি দাবি করেছেন, হামাসের হাতে জীবিত জিম্মিদের সংখ্যা হয়তো আরও কমে গেছে।
ট্রাম্প সতর্ক করেছেন, জিম্মিদের মুক্তি না দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ ও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মূলত ইসরাইলকে সময় দেওয়ার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গাজা যুদ্ধ এখন এক নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। হাজারো শিশু ও নারী নিহত, লাখো মানুষ আহত, পুরো উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত, তবু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। গাজার মানুষ আজ শুধু জীবন নয়, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ