
ছবি: সংগৃহীত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলমান। এই দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কোনো স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় আবারও আলোচনার প্রসঙ্গ সামনে এসেছে। তবে শান্তি উদ্যোগ যতটা আলোচিত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি করছে পক্ষগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও শর্ত।
বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দেন, তিনি কখনোই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা বাতিল করেননি। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “যদি জেলেনস্কি বৈঠকের জন্য প্রস্তুত থাকেন, তাহলে তাকে মস্কোয় আসতে দিন।”
পুতিন আরও সতর্ক করে বলেন, যদি কোনো শান্তিচুক্তি না হয়, তাহলে রাশিয়া সামরিক উপায়ে তার লক্ষ্য অর্জন করবে। তাঁর ভাষায়, “যদি সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখা যায়, তাহলে একটি চুক্তির মাধ্যমে সংঘাতের অবসান ঘটতে পারে। আর যদি তা না হয়, তাহলে সামরিক পথই হবে সমাধান।”
বেইজিং সফরে পুতিন শুধু সংবাদ সম্মেলনেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই বৈঠকগুলো শুধু প্রতীকী নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তি ভারসাম্যে একটি নতুন বার্তা বহন করছে।
রুশ প্রেসিডেন্টের এমন প্রস্তাবকে ইউক্রেন সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিগা জানান, কয়েকটি দেশ—বিশেষত জি-সেভেন সদস্যরা—আগেই দুই নেতার মধ্যে আলোচনার আন্তরিক প্রস্তাব দিয়েছিল। জেলেনস্কিও যে কোনো সময় বৈঠকে বসতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু পুতিন এখন এমন প্রস্তাব দিচ্ছেন, যা বাস্তবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং মূলত কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
কিয়েভের অবস্থান স্পষ্ট: ইউক্রেন তার ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে কোনো চুক্তি করবে না। বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়ার দখলে নেওয়া চারটি অঞ্চল নিয়ে কোনো আপসের প্রশ্নই ওঠে না।
ইউক্রেন সংকট সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত আগস্টের মাঝামাঝি তিনি আলাস্কায় পুতিন এবং ওয়াশিংটনে জেলেনস্কির সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল, দুই নেতার মধ্যে সরাসরি আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা। তবে এখন পর্যন্ত এ উদ্যোগ কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে পারেনি।
এর মধ্যেই ট্রাম্প বুধবার আবারও হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে রাশিয়াকে ‘অনির্দিষ্ট পরিণতির’ হুমকি দেন। তিনি বলেন, “পুতিনের সিদ্ধান্ত যাই হোক, আমরা হয় তাতে সন্তুষ্ট হব বা অসন্তুষ্ট হব। আর যদি অসন্তুষ্ট হই, তাহলে কী ঘটতে পারে তা সবাই দেখতে পাবে।” তাঁর এই বক্তব্যকে অনেকেই নতুন নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর কূটনৈতিক পদক্ষেপের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পুতিনের প্রস্তাব মূলত একটি কৌশল, যা কিয়েভকে চাপের মুখে ফেলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে নিজেকে আলোচনায় ইচ্ছুক এক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা। অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রত্যাখ্যান ছিল প্রত্যাশিত, কারণ তারা নিজেদের ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে কোনো সমঝোতা করতে পারবে না।
ট্রাম্পের মধ্যস্থতার চেষ্টা কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শক্ত হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও রাশিয়া তাদের দখলকৃত অঞ্চল ছাড়তে মোটেও প্রস্তুত নয়।
বর্তমান পরিস্থিতি অনেকাংশেই অনিশ্চিত। একদিকে রাশিয়া আলোচনার দরজা খোলা রেখেছে বলে দাবি করছে, অন্যদিকে ইউক্রেন স্পষ্ট জানাচ্ছে, সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে কোনো সমঝোতা নয়। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই অবস্থার মধ্যেই একদিকে আলোচনার উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে মস্কোকে ভয় দেখাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সামনে আলোচনার কোনো সুরাহা না হলে, সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ