
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আর কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, কিংবা সরকারি কোনো পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না—এমন নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এতে সরকারের সব উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের সামনে সিদ্ধান্তটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কেউ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। একইসঙ্গে তারা কোনো সরকারি পদেও নিয়োগযোগ্য হবেন না।”
এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। দীর্ঘদিন ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও নির্বাচনী অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক ছিল। এবার উপদেষ্টা পরিষদের নীতিগত অনুমোদনের মাধ্যমে সেই বিতর্কে সুস্পষ্ট অবস্থান জানাল অন্তর্বর্তী সরকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কারণ, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের সক্রিয় রাজনীতির বাইরে রাখলে নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু হবে।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে শুধুমাত্র মানবতাবিরোধী অপরাধীদের নির্বাচনী অযোগ্যতা নয়, দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং বর্তমান প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল। পরিষদ এ বিষয়ে অবগত এবং সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, বরং ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদসহ সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। অর্থাৎ, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কেউ কোনো পর্যায়ের নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবেন না।
প্রেস সচিব বলেন, “আমরা চাই, সব পর্যায়ের নির্বাচনে যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীরাই অংশ নিক। এ কারণে এ সিদ্ধান্তকে শুধু সংসদ নির্বাচন নয়, বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও প্রযোজ্য করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।”
বৈঠকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল প্রযুক্তি খাতের নীতিমালা অনুমোদন। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব জানান, টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্স নীতিমালা-২০২৫ চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এর মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ খাতের সুশাসন, প্রতিযোগিতা ও সেবার মান উন্নত করার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
বৈঠকের পর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বৈঠকের বিস্তারিত জানাতে হাজির হন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব। তারা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন এবং সরকারের অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন।
শফিকুল আলম বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করতে যা যা প্রয়োজন, সব পদক্ষেপই নিচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।”
এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একদিকে যেমন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানও স্পষ্ট করছে। এর ফলে দেশের ভেতরে ও বাইরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা আরও দৃঢ় হবে বলে তারা মনে করছেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, উপদেষ্টা পরিষদের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কারে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করলো। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা কেবল ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে আরও সুসংহত করার একটি বড় পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ