
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশজুড়ে নিত্যদিন বাড়ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, সহিংসতা ও অপরাধ। একের পর এক গণসহিংসতা, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অপহরণ, চুরি, ছিনতাই এবং চোরাচালান—সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ আজ চরম অনিরাপত্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। ফলে প্রতিদিনই মানুষের মনে নতুন করে আতঙ্ক জন্ম নিচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার’ দেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, পুলিশ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে পূর্ণাঙ্গ কঠোর ভূমিকা নিতে পারছে না। এর পেছনে দুটি বড় কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে—প্রথমত, সরকারের মানবাধিকার নীতি, যাতে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সবসময় শঙ্কা তৈরি হয়; দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সহযোগিতার অভাব। রাজনৈতিক সরকার থাকাকালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা—এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলররা—পুলিশকে সহযোগিতা করতেন। এখন সেই সহায়তা না থাকায় পরিস্থিতি মোকাবিলা কঠিন হয়ে উঠেছে।
গত এক বছরে সংঘটিত ৩৩৪টি গণসহিংসতার মধ্যে ২১৯টিতেই পুলিশ সদস্যরা সরাসরি ভিকটিম হয়েছেন। থানা আক্রমণ হয়েছে ১২টি, আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে ৫৭টি ঘটনায়, আর বিভিন্নভাবে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে ১৫০ বারেরও বেশি। ছাত্র আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে এখনো অনেক পুলিশ সদস্য ছাত্র দেখলেই ভয়ের মধ্যে থাকেন। এতে পুলিশের মানসিক দৃঢ়তায় ভাঙন ধরেছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে আমরা চেষ্টা করছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে। তবে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ না করার সরকারি নীতি থাকায় আমরা অনেক সময় বলপ্রয়োগ করতে পারি না। ফলে অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে।”
অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, “রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুলিশ মানুষের ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এতে পুলিশ মানসিকভাবে ব্যাকফুটে চলে যায়। এ সুযোগে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে গত এক বছরে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, দ্রুতই আরও উন্নতি হবে।”
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে ২,২১৬টি হত্যা মামলা, ৪২৬টি ডাকাতি মামলা, ৬২৫টি অপহরণ মামলা, ৫,৩৮৭টি চুরির মামলা এবং ১০,১০৯টি চোরাচালানের মামলা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আসকের তথ্য বলছে, এ সময়ের মধ্যে ৪৯২টি ধর্ষণ, ২৯টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬১ জনের কারাগারে মৃত্যু, ১৬৫ সাংবাদিকের ওপর হামলা, ৬,৩৯০ জন রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহত, এবং ১০৮ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই সময়ে ৪৮৮ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৮ জন, আর যৌতুক-সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৩৩ জন নারী।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৮০টি মাজারে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। অন্যান্য মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে ৩৫টি। তবে সবগুলো ঘটনায় মামলা হয়নি। কেবল চারটিতে নিয়মিত মামলা এবং পাঁচটিতে জিডি হয়েছে। সবমিলিয়ে ৩৩৪টি গণসহিংসতার ঘটনায় পুলিশের ভিকটিম হওয়ার হার দাঁড়িয়েছে ৬৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
ভয়ংকর কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা
-
ঢাকার মালিবাগে সোহাগ পরিবহণের পরিচালক আলী হাসান পলাশ তালুকদারের বাসা ও কাউন্টারে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হন।
-
মোহাম্মদপুর আদাবরে কিশোর গ্যাং পুলিশের ওপর হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হন কনস্টেবল আল-আমিন।
-
১২ মার্চ মোহাম্মদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আসামি গ্রেফতার করতে গিয়ে মবের শিকার হয় পুলিশ। আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় পুলিশের হাত থেকে।
-
২২ আগস্ট ময়মনসিংহের কৃষ্টপুরে মব দমন করতে গিয়ে তিন পুলিশ সদস্য আহত হন।
-
২২ আগস্ট চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে চোর সন্দেহে তিন কিশোরকে আটক করে মব; নিহত হয় কিশোর মাহিন (১৫)।
-
২৩ আগস্ট চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
-
৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হামলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ২১০ জন অবরুদ্ধ থাকেন। এতে বিএনপি নেতা কুসুম বড়ুয়া ও যুবলীগ নেতা হানিফ-ইকবালের নাম উঠে আসে।
-
৭ আগস্ট গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
-
৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালে ব্যবসায়ী লাল চাঁদকে (৩৯) পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “আইনশৃঙ্খলার ঘাটতিগুলোকে কাজে লাগিয়ে মব, চাঁদাবাজি, সংঘাতসহ নানা অপরাধ ঘটানো হচ্ছে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা কাজ করছে। অপরাধীরা এটাকে বড় সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে। যখন তারা জানে শাস্তি নিশ্চিত হবে না, তখন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।”
সব পরিসংখ্যান, সব ঘটনার বিবরণ স্পষ্ট করে বলছে—আজকের বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ আর নিরাপদ নন। পুলিশের সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক সহযোগিতার অভাব, মানবাধিকার নীতির শঙ্কা এবং অপরাধীদের দুঃসাহস—সব মিলিয়ে দেশজুড়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করলেও বাস্তবে নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ