
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি ‘স্বৈরশাসক’ আখ্যা দিয়ে দেশটিকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করার ডাক দিয়েছেন অস্ট্রিয়ার অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিক গুনথার ফেলিঙ্গার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ পরিচিত এই ব্যক্তিত্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (পূর্বের টুইটার) পোস্ট করে ভারত বিভক্তির একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন, যেখানে দেশটিকে ধর্ম, জাতি ও ভাষার ভিত্তিতে ভাগ করে একাধিক ছোট ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করার চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। এই পোস্ট প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক ও সমালোচনা।
ঘটনার পেছনে সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। সম্প্রতি রাশিয়া থেকে তেল আমদানির কারণে ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো অভিযোগ করেছে, ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার কাছ থেকে সরাসরি তেল না কিনে ভারতের কাছ থেকে শোধিত তেল কিনছে, অথচ একই সময়ে ভারতকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এমন সংবেদনশীল সময়ে ইউরোপের একাংশ থেকে ভারত ভাঙার ডাক ওঠা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে আরও আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। ভারতীয় মিডিয়া এটিকে ‘সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে।
গুনথার ফেলিঙ্গার তার এক্স অ্যাকাউন্টে লেখেন— “আমি ভারত ভেঙে দেওয়ার ডাক দিচ্ছি। নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার লোক। আমাদের মুক্ত খালিস্তান দরকার।”
শুধু লেখাই নয়, তিনি একটি মানচিত্র পোস্ট করেন যেখানে ভারতের ভেতর একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রকে চিত্রিত করা হয়েছে। সেই মানচিত্রে দেখা যায়—
-
উত্তর ভারতের বিশাল অংশকে আলাদা করে দেখানো হয়েছে ‘খালিস্তান’ নামে।
-
পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, উত্তর-পূর্ব ভারত, কেরালা ও তামিলনাড়ুসহ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
-
প্রতিটি অঞ্চলকে আলাদা পতাকার রঙে সজ্জিত করে দেখানো হয়েছে যে, ভারত আর একক রাষ্ট্র নয়, বরং বহু রাষ্ট্রের সমাহার।
ফেলিঙ্গার তার পোস্টে আরও জানান, তিনি “শিখ ন্যারেটিভ” নামে একটি এক্স হ্যান্ডেলের সঙ্গে টানা দুই ঘণ্টা আলোচনা করেছেন। আলোচনার বিষয় ছিল— কীভাবে খালিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে এবং ভারতের বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে ‘সাবেক ভারত’ (Former India) তৈরি করা যায়।
তিনি দাবি করেন, মোদি একজন ‘রাশিয়াপন্থি স্বৈরশাসক’, যিনি ভারতের জনগণকে একনায়কতান্ত্রিকভাবে শাসন করছেন। ফেলিঙ্গারের মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ভারতের জনগণকে এই ‘স্বৈরশাসন’ থেকে মুক্ত করতে সহযোগিতা করা।
গুনথার ফেলিঙ্গার অস্ট্রিয়ায় পরিচিত একজন অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদ। তিনি ইউক্রেন, কসোভো, বসনিয়া ও অস্ট্রিয়ার ন্যাটো সদস্যপদ সংক্রান্ত অস্ট্রিয়ান কমিটির প্রেসিডেন্ট। যদিও এই কমিটি ন্যাটোর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, তবে ফেলিঙ্গার ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক নীতিতে সক্রিয়ভাবে মতামত দিয়ে থাকেন।
এর আগে তিনি ইউক্রেন সংকট ও পশ্চিম বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। তবে ভারতের মতো বৃহৎ রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলার ডাক দেওয়া নিঃসন্দেহে তার সবচেয়ে আলোচিত বক্তব্যগুলোর একটি হয়ে উঠেছে।
ভারতের রাজনৈতিক মহলে এই মন্তব্যকে সরাসরি ‘উসকানি’ এবং ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে খালিস্তান প্রসঙ্গটি ভারতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতির জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের মন্তব্য ভারতের ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত। ইউরোপীয় একজন অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদের মুখে এমন বক্তব্য প্রকাশ পাওয়া কেবল সম্পর্ককে ক্ষুণ্ণই করবে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক মহলেও এই পোস্টকে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বিতর্কিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। পশ্চিমা কূটনীতিকদের একাংশ মনে করছেন, ফেলিঙ্গারের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত মতামত, যা কোনো রাষ্ট্রীয় বা আনুষ্ঠানিক অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না।
বর্তমানে ভারত বৈশ্বিক ভূরাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে দেশটি। ঠিক এমন সময়ে ইউরোপীয় এক কূটনীতিকের ভারত বিভক্তির ডাক দেওয়া নিঃসন্দেহে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিল।
সংক্ষেপে বলা যায়, ফেলিঙ্গারের এই পোস্ট শুধু ভারতে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তবে এটি কতটা গুরুত্ব পাবে, কিংবা এর প্রভাব বাস্তব রাজনীতিতে কতদূর বিস্তৃত হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ