
ছবি: সংগৃহীত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে চীনের বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বেইজিংয়ে আয়োজিত এক মহাসমারোহ সামরিক কুচকাওয়াজ বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ঝলমলে এই কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা। তবে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন তিন নেতা—চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন। এক ফ্রেমে ধরা পড়া এই তিন নেতার উপস্থিতি শুধু কুচকাওয়াজের মহিমা বাড়ায়নি, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের বার্তাও দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে চীন যে আর একা নয়, বরং পশ্চিমা-বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত—এই কুচকাওয়াজ সেই শক্ত বার্তাই দিয়েছে।
শুরুর আগেই শক্তির ইঙ্গিত
বুধবার স্থানীয় সময় সকাল থেকেই বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে শুরু হয় এক ব্যতিক্রমী পরিবেশ। ঐতিহাসিক ওই স্থানে জড়ো হন ২৬ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। শুরুর আগে ৮০ বার তোপধ্বনি ছুড়ে বিজয়ের প্রতীকী বার্তা দেওয়া হয়। শি জিনপিংয়ের সামরিক পোশাক পরা উপস্থিতি এবং সেনাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ কুচকাওয়াজ এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
এরই মধ্যে গণমাধ্যমে সর্বাধিক সাড়া ফেলে দেয় শি, পুতিন ও কিমের একসঙ্গে বসা। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকে এটিকে “পশ্চিমা বিশ্বের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া এক প্রতীকী দৃশ্য” বলে অভিহিত করছেন।
শি জিনপিংয়ের ভাষণ
কুচকাওয়াজের মূল আকর্ষণ ছিল চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ভাষণ। তিনি বলেন, “চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি সবসময় জনগণের আস্থা ও নির্ভরযোগ্য শক্তি। চীনারা যুদ্ধকে ভয় পায় না। জাতীয় ঐক্য ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় আমাদের সেনারা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।”
তিনি আরও যোগ করেন, “সকল কর্মকর্তার দায়িত্ব হবে নিষ্ঠা ও আনুগত্যের সঙ্গে সেনাবাহিনীকে বিশ্বমানের পর্যায়ে উন্নীত করা। চীন কখনো কোনো আগ্রাসনের কাছে মাথা নত করবে না।” শির এই বক্তব্যকে বিশ্লেষকরা শুধু অভ্যন্তরীণ বার্তাই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উদ্দেশে কড়া সতর্কবার্তা হিসেবেই দেখছেন।
আধুনিক অস্ত্রের প্রদর্শন
শির ভাষণের পরপরই শুরু হয় আধুনিক অস্ত্রের প্রদর্শন। প্রায় ৭০ মিনিটব্যাপী কুচকাওয়াজে দেখানো হয় চীনের সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক ও ড্রোন।
প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে আসে ডিএফ-৬১ আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল—যা কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। প্রদর্শিত হয় জেএল-৩ সাবমেরিন-লঞ্চড ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং হাইপারসনিক অ্যান্টি-শিপ মিসাইল ওয়াইজে-২০, যেগুলো মূলত মার্কিন নৌবাহিনী এবং তাইওয়ান প্রণালীতে ওয়াশিংটনের সামরিক উপস্থিতি ঠেকাতে পরিকল্পিত।
এছাড়া নতুন প্রজন্মের ৯৯বি মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক, পিএইচএল-১৬ মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধের জন্য তৈরি লয়্যাল উইংম্যান ড্রোনও নজর কেড়েছে। এসব অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে চীন বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে যে তাদের প্রযুক্তি কেবল উন্নতই নয়, দ্রুত গতিতেও অগ্রসর হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই কুচকাওয়াজকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন, “চীনের প্রেসিডেন্ট শি কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান মনে রেখেছেন?” যদিও তিনি চীনা জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তবে পুতিন ও কিমকে নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন।
ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার নেতারা একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এদিকে মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “চীন এই কুচকাওয়াজের মাধ্যমে শুধু সামরিক শক্তি নয়, কূটনৈতিক বার্তাও দিয়েছে। ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের বিপরীতে এখন একটি সমান্তরাল শক্তির অক্ষ গড়ে উঠছে।”
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরে নতুন সমীকরণ
চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার একসঙ্গে মঞ্চে দাঁড়ানো অনেককেই ঠাণ্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখন এই কুচকাওয়াজকে বেইজিংয়ের কৌশলগত ‘পাওয়ার শো’ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে শুরু করে দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান প্রণালী—সবক্ষেত্রেই চীনের অবস্থান যে অনমনীয়, তার প্রমাণ দিয়েছে এই প্রদর্শনী। আর পশ্চিমা-বিরোধী নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে চীন দেখিয়ে দিয়েছে, তারা এখন শুধু আঞ্চলিক শক্তি নয়, বৈশ্বিক নেতৃত্বের দাবিদার।
বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারের এই সামরিক কুচকাওয়াজ নিছক একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি ছিল চীনের শক্তি, আত্মবিশ্বাস এবং ভূরাজনৈতিক বার্তার প্রতীক। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে চীন বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে, তারা নতুন এক বৈশ্বিক সমীকরণ গড়তে প্রস্তুত। আর এই বার্তাই হয়তো আগামী কয়েক বছর আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ