
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও বিশ্ব রাজনীতিতে ঝড় তোলা এক বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর দাবি, চীনের বেইজিংয়ে আয়োজিত বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজকে কেন্দ্র করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন একত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। এই মন্তব্যের পর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০ বছর পূর্তিতে সামরিক শক্তি প্রদর্শন
বেইজিংয়ের ঐতিহাসিক তিয়েনআনমেন স্কয়ারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এ কুচকাওয়াজে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বজুড়ে শীর্ষ সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা। আয়োজক দেশ চীন তাদের সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র প্রদর্শন করে, যার মধ্যে ছিল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ইলেকট্রনিক্স ধ্বংসে সক্ষম নতুন প্রজন্মের লেজার অস্ত্র, সনাক্তকরণ এড়াতে পারে এমন উন্নতমানের সাবমেরিন এবং স্থলভিত্তিক মানববিহীন যুদ্ধ ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের এই প্রদর্শনী মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছে এক ধরনের ‘শক্তির বার্তা’।
শি জিনপিংয়ের শক্ত বার্তা
কুচকাওয়াজ উদ্বোধনের সময় শি জিনপিং বলেন, “বিশ্ব আজও শান্তি অথবা যুদ্ধের বিকল্পের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।” তিনি আরও ঘোষণা দেন যে, চীন ‘অপ্রতিরোধ্য’ এবং দেশটির সামরিক সক্ষমতা যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত। এই বক্তব্যকে অনেক বিশ্লেষক যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে এক ধরনের সরাসরি সতর্কবার্তা হিসেবেই দেখছেন।
বিশেষ অতিথি পুতিন ও কিম
এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে তিয়ানানমেন গেটে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। তাদের পাশাপাশি বসে সামরিক কুচকাওয়াজ উপভোগ করার দৃশ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। পশ্চিমা বিশ্বে এটি এক নতুন ধরনের ‘অক্ষশক্তির প্রদর্শনী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ট্রাম্পের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
কুচকাওয়াজের পরদিনই নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি লিখেন, “প্রেসিডেন্ট শি, যেহেতু আপনারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, অনুগ্রহ করে ভ্লাদিমির পুতিন এবং কিম জং উনকে আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাবেন।” তাঁর বার্তায় ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গি স্পষ্ট হলেও এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের ছাপও ধরা পড়ে। তিনি শেষ করেন শুভেচ্ছা জানিয়ে—“প্রেসিডেন্ট শি এবং চীনের অসাধারণ জনগণের উদযাপন একটি মহান এবং দীর্ঘস্থায়ী দিন হয়ে থাকুক।”
রাশিয়ার জবাব: ‘কোনো ষড়যন্ত্র নেই’
ট্রাম্পের অভিযোগের পরপরই প্রতিক্রিয়া জানায় রাশিয়া। ক্রেমলিনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সহকারী ইউরি উশাকভ সাংবাদিকদের বলেন, “আমি বলতে চাই, কেউ কোনো ষড়যন্ত্র করেনি। এই তিন নেতার কারো মাথায়ই এমন কোনো চিন্তাভাবনা নেই।” রাশিয়ার পক্ষ থেকে এ ধরনের স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না জড়ানোর কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানে কাছাকাছি আসছে। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যযুদ্ধ এবং ভূ-রাজনৈতিক চাপের ফলে এই তিন দেশের মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। যদিও প্রকাশ্যে কেউ ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দ ব্যবহার করছে না, তবে একসঙ্গে উপস্থিতি এবং সামরিক শক্তির প্রদর্শন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ধরনের পরোক্ষ বার্তা।
তেল, বাণিজ্য ও কৌশলগত জোট
সম্প্রতি তেল রপ্তানি ও জ্বালানি বাণিজ্যের মাধ্যমেও রাশিয়া, চীন ও ভারত ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। চীন তাদের বাজারে রাশিয়ার তেলের বড় ক্রেতায় পরিণত হয়েছে, আর উত্তর কোরিয়া চীনের ওপর নির্ভরশীল অর্থনৈতিক টিকে থাকার জন্য। এই ত্রিভুজ সম্পর্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কিছুটা হলেও সীমিত হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক অভিযোগ বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যদিও রাশিয়া সরাসরি অস্বীকার করেছে, তবে শি-পুতিন-কিম একসঙ্গে সামরিক কুচকাওয়াজে উপস্থিত হওয়ার দৃশ্য বিশ্বব্যাপী এক ধরনের রাজনৈতিক বার্তা বহন করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই বার্তা কেবল প্রতীকী, নাকি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নতুন এক অক্ষশক্তি গঠনের ইঙ্গিত—তা সময়ই বলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ