
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও বিশ্বখ্যাত পর্যটন শহর কক্সবাজার এবার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মর্যাদা পেতে যাচ্ছে। সমুদ্রের বুক চিরে নির্মিত দীর্ঘতম রানওয়ে, নতুন টার্মিনাল ভবন ও আধুনিক অবকাঠামোর সমন্বয়ে এই বিমানবন্দর কেবল পর্যটন শিল্পেই নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়েই এখান থেকে আংশিকভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার আশা প্রকাশ করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
বেবিচক চেয়ারম্যানের আশাবাদ
বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজার বিমানবন্দর পরিদর্শনে এসে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আজ দ্বিতীয় টার্মিনাল এবং সমুদ্রের ওপর নির্মিত রানওয়ের অগ্রগতি পরিদর্শন করেছি। এ অগ্রগতিতে মনে হচ্ছে, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করা সম্ভব হবে।” তিনি আরও জানান, শতভাগ কাজ শেষ না হলেও বিমান চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
দেশের দীর্ঘতম রানওয়ে এখন কক্সবাজারে
কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের অন্যতম বড় সাফল্য হলো রানওয়ের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি। বিদ্যমান রানওয়ে বাড়ানো হয়েছে অতিরিক্ত ১ হাজার ৭০০ ফুট, যার পুরো অংশ সমুদ্রের ভেতরে পাইলিং করে নির্মিত। এর ফলে রানওয়ের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭০০ ফুট—যা বর্তমানে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রানওয়ে। এ কারণে এখন বিশ্বের আধুনিক ও বড় আকারের বিমানও সহজেই এখানে অবতরণ করতে পারবে।
প্রকল্প কো-অর্ডিনেটর এম. মোশাররফ হোসেন জানান, “রানওয়ের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। লাইটিং ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে। এখন বৈদ্যুতিক সংযোগের কাজ চলছে, যা এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। পাশাপাশি বর্ধিত অংশের পেইন্টিংয়ের কাজও দ্রুত শেষ করা সম্ভব হবে।”
টার্মিনাল ভবনের অগ্রগতি
যদিও রানওয়ে প্রস্তুত, তবে নতুন টার্মিনাল ভবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখনও বাকি আছে। বিশেষ করে যাত্রী অভ্যর্থনা, ইমিগ্রেশন, কনভেয়র বেল্ট এবং নিরাপত্তা চেকের মতো জায়গাগুলোতে দ্রুতগতিতে কাজ চলছে।
বিমানবন্দরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মঈনুদ্দিন জানান, “টার্মিনাল ভবনের নিচতলায় যাত্রী আগমনের অংশে জোরেশোরে কাজ চলছে। আশা করছি ২০–২৫ দিনের মধ্যে এগুলো শেষ করা সম্ভব হবে। তবে পুরো ভবনের কাজ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।”
পর্যটন শিল্পে বিপ্লবের আশা
কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর। এখানে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভাবে বিদেশি পর্যটক আসা সীমিত ছিল। নতুন সুবিধা চালু হলে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পর্যটক আসবে। এতে হোটেল, রিসোর্ট, পরিবহন, খাদ্যপানীয় শিল্প এবং স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপুল পরিবর্তন আসবে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “বিমানবন্দরের উদ্বোধন কক্সবাজারের অর্থনীতির জন্য গেমচেঞ্জার হবে। তবে এর সঙ্গে কাস্টমস, ইমিগ্রেশন ও বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মতো সুবিধাও দ্রুত চালু করতে হবে। তবেই প্রকল্পের পূর্ণ সুফল মিলবে।”
নিরাপত্তা ও সেবার মান নিয়ে গুরুত্ব
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানবন্দর চালু হলে শুধু পর্যটন নয়, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগেও বিপ্লব ঘটবে। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে নিরাপত্তায়।
এভিয়েশন বিশ্লেষক নাফীস ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, “কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য প্রস্তুত হলেও সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে টেকনাফ, ইনানি ও উখিয়ার মতো এলাকায় আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা জরুরি। নিরাপত্তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মানের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।”
আঞ্চলিক হাবে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন
কক্সবাজার বিমানবন্দরের উন্নয়ন পরিকল্পনা শুরু হয় ২০০৯ সালে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। সরকার চায় এই বিমানবন্দরকে শুধু পর্যটনের কেন্দ্র হিসেবেই নয়, বরং আঞ্চলিক হাব ও টেকনিক্যাল ল্যান্ডিং পয়েন্ট হিসেবেও গড়ে তুলতে। ভৌগোলিকভাবে বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে এটি ভবিষ্যতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।
অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হলে কক্সবাজার হবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শহর। বিদেশি পর্যটক ও বিনিয়োগকারীদের আগমন, হোটেল ও রিসোর্ট শিল্পের প্রসার, স্থানীয় ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রসার—সব মিলিয়ে এ বিমানবন্দর দেশের অর্থনীতিতে নতুন সূর্যের উদয় ঘটাবে।
প্রকল্প পরিদর্শনে কর্মকর্তারা
বেবিচক চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিকীর সঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ ইউনূস ভূঁইয়া, ব্যবস্থাপক গোলাম মোর্তজা হাসানসহ বিভিন্ন প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা বিমানবন্দর কাজের অগ্রগতি ঘুরে দেখেন। তারা সবাই জানান, নির্ধারিত সময়ের আগেই আংশিকভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর মতো প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আর কেবল একটি অবকাশকেন্দ্রের সহায়ক অবকাঠামো নয়; এটি হতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম কৌশলগত কেন্দ্র। সঠিক পরিকল্পনা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও মানসম্পন্ন সেবা বজায় রাখা গেলে, এই প্রকল্প কেবল কক্সবাজারের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক অনন্য মাইলফলক হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ