
ছবি: সংগৃহীত
টেকনাফের নাফ নদীতে এখন আতঙ্কের অন্য নাম আরাকান আর্মি। বিদ্রোহী এ গোষ্ঠী গত চার দিনে ৬টি ট্রলারসহ ৪৪ জন বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। একের পর এক অপহরণের ঘটনায় সীমান্ত উপকূলে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতা।
২৬ আগস্ট সকালে শাহপরীর দ্বীপের পূর্ব-দক্ষিণে নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় মাছ শিকার শেষে টেকনাফ ফেরার পথে আরও দুটি ট্রলারসহ ১১ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। ওই ট্রলারের মাঝি আব্দুল হাফেজের সঙ্গে সর্বশেষ ফোনে কথা বলেন কায়ুকখালিয়া ঘাট ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম। তিনি জানান, “স্পিডবোটে করে এসে তারা আমাদের জেলেদের ধাওয়া দিয়ে আটক করে। মুহূর্তের মধ্যেই অস্ত্র ঠেকিয়ে মিয়ানমারের দিকে নিয়ে যায়। এরপর থেকে কোনো খোঁজ নেই।”
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, গত আট মাসে প্রায় ২৫০ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। তাদের মধ্যে ১৮৯ জনকে ফিরিয়ে আনা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে যারা নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। শুধু আগস্ট মাসের ২২ দিনে অন্তত ৫১ জন জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা দিন-রাত জেটিঘাটে ভিড় করছেন প্রিয়জনদের ফেরার অপেক্ষায়।
স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, নাফ নদীর বাংলাদেশের জলসীমায় অবাধে ঢুকে পড়ছে আরাকান আর্মি। স্পিডবোট নিয়ে ট্রলারে ওঠে অস্ত্রের মুখে জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বিজিবির টহল থাকলেও তাদের সাহস কমছে না। জেলে মালিকদের ভাষ্য, “প্রতিদিন এভাবে অপহরণ হতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে হাজার হাজার পরিবার পথে বসবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাখাইন রাজ্যে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের ভয়াবহ সংকটই এ অপহরণের মূল কারণ। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, “মিয়ানমারের জান্তার সাথে সংঘাতে আরাকান আর্মি কার্যত বিচ্ছিন্ন। তারা বাংলাদেশি জেলেদের ধরে মুক্তিপণ আদায় করছে। সীমান্তে সমন্বিত টহল বাড়ানো এখন জরুরি।”
অন্যদিকে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর মনে করেন, এ তৎপরতার নেপথ্যে রাজনৈতিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্যও রয়েছে। তার মতে, “আরাকান আর্মি সীমান্তে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। তারা শুধু জেলেদের অর্থ লুট করছে না, বরং রোহিঙ্গাদের ভয় দেখাচ্ছে। এতে রোহিঙ্গাদের নতুন অনুপ্রবেশ ঠেকানোরও চেষ্টা রয়েছে।”
স্থানীয় পর্যায়ে জেলেদের পরিবারগুলো এখন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। নিখোঁজ জেলেদের স্বজনরা প্রতিদিন ঘাটে ভিড় করছেন, কাঁদছেন, প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কেউ কেউ বলেন, “আমাদের স্বজনদের যদি ফিরিয়ে আনা না যায়, তাহলে নাফ নদীতে আর কাউকে নামতে দেওয়া উচিত হবে না।”
টেকনাফ উপকূলে এখন চারদিকে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—নাফ নদী কি আর জেলেদের জন্য নিরাপদ থাকবে? নাকি এই নদী পরিণত হবে আরাকান আর্মির স্থায়ী ভয়ের রাজ্যে?
বাংলাবার্তা/এমএইচও