
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সিলেট দীর্ঘদিন ধরেই পাথর উত্তোলনের জন্য পরিচিত এলাকা। একদিকে খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার, অন্যদিকে পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে বহুবার এ এলাকায় পাথর কোয়ারি বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু সরকার ও আদালতের বারবার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সিলেটে পাথর লুটপাট যেন থামছেই না। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য—রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, এমনকি স্থানীয় প্রভাবশালী মহল সবাই মিলে পাথর লুটে যুক্ত হয়েছেন। এভাবে কেবল কয়েক মাসেই প্রশাসনের পকেটে ঢুকেছে অন্তত ৮০ কোটি টাকা, আর লুট হওয়া পাথরের বাজারমূল্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের রাজনীতিতে বড় পালাবদলের পর সারা দেশে রাজনৈতিক মাঠ অনেকটা নীরব হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান, বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপিও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু রাজনীতির মাঠে বিরোধী চরিত্রে থাকা এসব দল সিলেটে এসে যেন হয়ে ওঠে একই মঞ্চের সহযোগী। দুদকের প্রতিবেদন বলছে—বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও এনসিপির অন্তত ৩১ জন নেতা সরাসরি পাথর লুটে জড়িত ছিলেন। তাদের সহযোগী ছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন, সাবেক শ্রমিকদল নেতা লাল মিয়া, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন দুদুসহ অন্তত ১৯ জন নেতার নাম উঠে এসেছে। তাদের অধিকাংশই স্থানীয়ভাবে পাথর ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
প্রতিবেদন অনুসারে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, জেলা আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, মনির মিয়া, হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান পাথর উত্তোলন ও পরিবহনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। জামায়াতের সিলেট মহানগর আমির ফখরুল ইসলাম, সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন, সাবেক উপজেলা আমির আজমান আলী ও মাস্টার শফিকুরের নামও এসেছে প্রতিবেদনে। এনসিপির জেলা প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরীও অভিযুক্ত হয়েছেন।
দুদকের তদন্ত বলছে, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ওসি থেকে শুরু করে এসআই ও কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই এই লুটপাটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রতি ট্রাক পাথর সরানোর জন্য গড়ে ১০ হাজার টাকা কমিশন নেওয়া হতো, যা ভাগ হয়ে যেত জেলা প্রশাসন, পুলিশ, থানা পর্যায় ও ডিবির কর্মকর্তাদের মধ্যে। শুধু তাই নয়, নদী থেকে নৌকায় পাথর তোলার ক্ষেত্রেও আলাদা ভাগ দেওয়া হতো। জেলা প্রশাসক, এসপি থেকে শুরু করে তহশিলদার ও এসিল্যান্ড পর্যন্ত কমিশন নিতেন।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ৮০ হাজার ট্রাকে পাথর সরানো হয়েছে। প্রতিটি ট্রাকে ৫০০ ঘনফুট পাথর থাকায় মোট লুট হওয়া পাথরের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ কোটি ঘনফুট। স্থানীয় বাজারে প্রতি ঘনফুট পাথরের দাম ৬০ থেকে ১৫০ টাকা হলেও হিসাব করা হতো গড়ে ১৮২ টাকা দরে। এভাবে লুট হওয়া পাথরের বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে—সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী পাথর লুট ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেননি, বরং তিনি ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন। সিলেটের সাবেক জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের বিরুদ্ধেও অবহেলা, সদিচ্ছার অভাব ও নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোম্পানীগঞ্জে দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন ইউএনও এবং কয়েকজন এসিল্যান্ডও এই লুটপাটে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন।
২০২৪ সালের ২৪ জুন সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সামনে জেলা পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে কোয়ারি ইজারার দাবিতে মানববন্ধন হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, রাজনীতিবিদদের এই প্রকাশ্য অবস্থানই পাথর লুটকে আরও উৎসাহিত করেছে। সরকার যদিও একই বছরের ২৭ এপ্রিল দেশের ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখে, তবু সিলেটের সংরক্ষিত এলাকাতেও পাথর লুট চলতে থাকে।
পরিবেশবাদীদের মতে, এ লুটপাট শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং সিলেট অঞ্চলের পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি। নদীর তলদেশ থেকে নির্বিচারে পাথর তোলায় নদী ভাঙন, ভূমিক্ষয় ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে ৮০ হাজার ট্রাকে পাথর সরানোর ফলে সড়ক অবকাঠামোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুদকের হাতে এখন পর্যন্ত একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন পৌঁছেছে। এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে সংস্থাটি। তবে জামায়াত ইসলামী অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম বলেছেন—“প্রতিবেদনে জামায়াতের কারো নাম নেই, গণমাধ্যম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবাদ প্রচার করছে। প্রমাণ ছাড়া দুদক এমন প্রতিবেদন করলে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে।”
সিলেটের পাথর লুটকাণ্ডের ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো যখন একযোগে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটে যুক্ত হয়, তখন জনসাধারণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও প্রশাসনের নৈতিক দেউলিয়াপনা এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। এখন দেখার বিষয়—দুদক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, নাকি এ প্রতিবেদনও অতীতের মতো ধুলোমাখা ফাইলেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ