
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদী যেন এক ভয়াল আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে চারজনের লাশ উদ্ধার করেছে নৌপুলিশ। পৃথক দুটি ঘটনায় উদ্ধার হওয়া এসব লাশের মধ্যে নারী, পুরুষ এবং একটি শিশুও রয়েছে। একসঙ্গে একদিনে এতগুলো লাশ ভেসে ওঠায় নদীর দুই পাড়ের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। স্থানীয়দের প্রশ্ন—বুড়িগঙ্গা কি এখন খুনিদের লাশ ফেলার স্থান হয়ে উঠছে?
শনিবার দুপুরে রাজধানীর সদরঘাট নৌ-পুলিশ বুড়িগঙ্গার মীরেরবাগ এলাকা থেকে আধ ঘন্টার ব্যবধানে নারী ও শিশুসহ দুজনের লাশ উদ্ধার করে। স্থানীয়রা প্রথমে নদীতে ভাসমান অবস্থায় তাদের দেখতে পান। খবর পেয়ে নৌ-পুলিশ লাশ উদ্ধার করে।
উদ্ধার হওয়া নারীটির বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর। তার পরনে ছিল সালোয়ার কামিজ এবং গলায় বোরকার হাতা পেঁচানো অবস্থায় ছিল, যা দেখে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া শিশুটি বয়স আনুমানিক ৩ থেকে ৪ বছর। তার গলায়ও ওড়না দিয়ে শক্তভাবে প্যাঁচানো ছিল। পুলিশের ধারণা, নারী-শিশুটি মা-ছেলে এবং দুজনকেই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা হঠাৎ দেখি পানিতে লাল রঙের কাপড়ের মতো কিছু ভাসছে। কাছে গিয়ে দেখি ওটা একটা শিশু। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকজন নারীর দেহ ভেসে ওঠে। এমন ঘটনা এর আগে দেখিনি। সত্যিই ভয়াবহ।”
এর কয়েক ঘণ্টা পর, শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আবারও বুড়িগঙ্গা নদী থেকে আরও দুটি লাশ উদ্ধার করে নৌপুলিশ। ঘটনাস্থল ছিল কেরানীগঞ্জ মডেল থানার কালিন্দী ইউনিয়নের মাদারীপুর ঘাট এলাকা।
উদ্ধার হওয়া এক পুরুষ ও এক নারীর লাশ একে অপরের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ছিল। পুরুষটির বয়স আনুমানিক ৪০ বছর। তার পরনে ছিল লাল রঙের চেক শার্ট ও একটি ট্রাউজার। নারীর বয়স আনুমানিক ৩০ বছর, তার পরনে ছিল লাল সালোয়ার ও ছাই রঙের গেঞ্জি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভাসমান লাশ দেখে এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে।
বরিশুর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মোক্তার হোসেন জানান, খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, “যুবক-যুবতীর একজনের হাত অপরজনের হাতের সঙ্গে বাঁধা ছিল। লাশ ফুলে যাওয়ায় চেহারা চেনা যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, মৃত্যুর সময় হয়েছে দুই থেকে তিন দিন আগে।”
উদ্ধার হওয়া চারজনের কারও পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। লাশগুলো সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। পরিচয় শনাক্তের জন্য ফরেনসিক টিমকে অবহিত করা হয়েছে।
সদরঘাট নৌ-পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, “এগুলো দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। নারী-শিশুর লাশের অবস্থা দেখে ধারণা করছি, তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। আবার যুবক-যুবতীর হাত বাঁধা থাকায় এটা স্পষ্ট হত্যার ইঙ্গিত দেয়।”
মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে চার লাশ উদ্ধার হওয়ায় বুড়িগঙ্গা পাড়ের মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, নদীতে প্রায়ই লাশ ভেসে উঠলেও একদিনে চারজনের লাশ উদ্ধার হওয়া এক নজিরবিহীন ঘটনা। কেরানীগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল মতিন বলেন, “আগে মাঝে মাঝে লাশ ভেসে উঠতে দেখেছি। কিন্তু একদিনে চারজন! এটা স্পষ্টভাবে সংগঠিত অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
আরেকজন দোকানি নুরুল হক বলেন, “আমাদের সন্তানদের নদীর ধারে যেতে দিতে ভয় হচ্ছে। নদীটা এখন আতঙ্কের জায়গা হয়ে গেছে।”
ঘটনার পর নৌপুলিশ জানিয়েছে, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। কেরানীগঞ্জ মডেল থানার এক কর্মকর্তা বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডগুলো পারিবারিক বা ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে ঘটতে পারে। তবে সংগঠিত চক্রও জড়িত থাকতে পারে। তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে।”
পুলিশ বলছে, বুড়িগঙ্গা ও এর আশপাশে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। একই দিনে চারটি লাশ উদ্ধারের ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও মাঠে নেমেছে।
অতীতে বহুবার বুড়িগঙ্গায় ভাসমান লাশ উদ্ধার হয়েছে। কখনো নিখোঁজ মানুষের লাশ, কখনো অপরাধচক্রের খুন করা শিকার। তবে একদিনে চার লাশ উদ্ধার নতুন করে প্রশ্ন তুলছে—নদী কি এখন হত্যাকারীদের লাশ গোপনের নিরাপদ স্থান হয়ে উঠছে?
একজন অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, “যদি দ্রুত তদন্তে অপরাধীদের ধরা না হয়, তবে এটা অন্যদেরও সাহসী করে তুলবে। নদীকে হত্যাকাণ্ড আড়াল করার জায়গা বানানো হলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ভয়াবহ রূপ নেবে।”
সংক্ষেপে বলা যায়, শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে বুড়িগঙ্গা নদীতে চারটি লাশ ভেসে ওঠায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিহতদের কেউ দুর্ঘটনায় পড়েননি, বরং প্রত্যেকের শরীরে হত্যাকাণ্ডের চিহ্ন মিলেছে। পুলিশ বলছে, ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই তদন্ত জোরদার করা হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ