
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত দেড় মাসে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ স্থিতিশীল হওয়া এবং আমদানি ব্যয় হ্রাস পাওয়ার ফলে টাকার বিপরীতে ডলারের দর দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই সুযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করেছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর প্রেক্ষাপটে ভিন্নধর্মী এক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
৭ দফা নিলামে ডলার কেনা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৩ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সাত দফা নিলামের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে মোট ৯৪৮ মিলিয়ন ডলার কেনা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করত—মূলত রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর আমদানি বিল পরিশোধে সহায়তা করার জন্য—এখন সেখানে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে।
গত তিন অর্থবছরে (২০২১-২২, ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪) বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। জ্বালানি তেল, সার এবং খাদ্যপণ্য আমদানির ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে সেই ডলার ব্যবহৃত হয়েছে। এর ফলে রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায় এবং দেশের আমদানি সক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়।
ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশল
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হঠাৎ করে টাকার দাম বেড়ে গেলে যেমন রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি ডলারের দাম অতিরিক্ত বেড়ে গেলেও বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। এজন্য ডলার কেনার মাধ্যমে বাজারে একটি ভারসাম্য বজায় রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখা। অতিরিক্ত উত্থান বা পতন কোনোটাই কাঙ্ক্ষিত নয়। ডলার দুর্বল হয়ে গেলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা নিরুৎসাহিত হয়, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।”
বর্তমানে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু রয়েছে। তবে কর্মকর্তারা জানান, যদি ডলারের দর ১২৩ টাকার ওপরে ওঠে বা ১২১ টাকার নিচে নামে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে। গত সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) ডলারের দর ছিল ১২১ টাকা ৭২ পয়সা।
রিজার্ভ পুনর্গঠন ও আইএমএফের শর্ত
রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফায় আমদানির জন্য ডলার সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। বিশেষ করে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময় এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। তবে পরবর্তীতে রেমিট্যান্সে অস্বাভাবিক প্রবাহ এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কারণে নতুন করে স্বস্তি আসে।
এ বছরের মার্চ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করলে এবং টাকার দরপতন কমে এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারও ডলার কেনা শুরু করে। এর আগে ২০২৪ সালের মে মাসে আইএমএফের ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করে বাংলাদেশ। তার এক বছর আগে ২০২৩ সালে চালু করা হয়েছিল ক্রলিং পেগ পদ্ধতি, যেখানে বিনিময় হার নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করত।
আইএমএফের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬.১৯ বিলিয়ন ডলারে। এক বছর আগে ২০২৪ সালের একই সময়ে রিজার্ভ ছিল মাত্র ২০.৫৯ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদদের মতামত
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান মনে করেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা কমেছে। তিনি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে টাকার দাম শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু টাকার মান অতিরিক্ত বেড়ে গেলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স উভয় খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে কৃত্রিমভাবে চাহিদা তৈরি করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কিনছে।”
তার মতে, এই পদক্ষেপ রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে সহায়ক হবে। একই সঙ্গে রিজার্ভ বাড়ানোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবিলার সক্ষমতাও বাড়বে। “আগামী ছয় মাসের জন্য এটি সঠিক কৌশল। রিজার্ভ পুনর্গঠন এখন জরুরি, আর ডলার কেনার মাধ্যমে ইতিবাচক ধারা বজায় রাখা সম্ভব হবে।”
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার কার্যকর থাকলেও তারা প্রয়োজনে ডলার কিনবে বা বিক্রি করবে। এর মাধ্যমে কৃত্রিম চাপ সৃষ্টি না করে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আগামী দিনে বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈদেশিক ঋণের চাপ—সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে নতুন চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। সেক্ষেত্রে রিজার্ভ শক্তিশালী রাখা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ