
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দেশের মূল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট হিসেবে হাজার হাজার টন পণ্য আমদানি-রপ্তানির কেন্দ্রবিন্দু হলেও বর্তমানে এক বড় সংকটে জর্জরিত। তৈরি পোশাক ও কাঁচামাল, জরুরি নথি, নমুনাপণ্য, খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামসহ বিভিন্ন পণ্য আকাশপথে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা বিমানবন্দর নির্ভর থাকলেও, অব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত ঘাটতি এবং দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
কার্গো গুদামের সংকট ও অব্যবস্থাপনা
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করছেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো গুদামের সংকট দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে। বর্তমানে গুদামের জন্য মাত্র ১৭ হাজার বর্গফুট জায়গা রয়েছে, যা প্রতিদিনের কার্গো ফ্লাইটের তুলনায় অপ্রতুল। গুদামের বাইরে পণ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হচ্ছে, খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টি, আর্দ্রতা এবং উড়োজাহাজের ক্রমাগত চলাচলের কারণে মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাফিকুর রহমান বলেন, “গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে বিমান দোষী নয়। ফ্লাইট অবতরণের পর পণ্য যথাস্থানে নামানো হয় এবং রপ্তানির জন্য নির্ধারিত ফ্লাইটে তা তুলে দেওয়া হয়। বাকি কাজ কাস্টমসের দায়িত্ব। তবে কার্গো ফ্লাইট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান অবকাঠামো এবং গুদামের সীমাবদ্ধতা ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।”
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “বেসিক্যালি, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতা টিকে আছে সময়মতো পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কারণে। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সীমাহীন জটিলতা ও অদক্ষতা রপ্তানিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। পর্যাপ্ত টার্মিনাল নেই, আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতার কারণে সময়মতো পণ্য পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এটি দেশের ভাবমূর্তি ও রপ্তানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
নতুন নিয়ম ও সরকারি বাধা
গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুল্ক কর্তৃপক্ষ নতুন নিয়ম চালু করেছে। শুল্কায়নের জন্য সাতটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট, লাইসেন্স ও পারমিট ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো সিস্টেমের মাধ্যমে দাখিল করা বাধ্যতামূলক। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, এই নিয়মের কারণে পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে অনাবশ্যক জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
এছাড়া, ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হওয়ায় শাহজালাল বিমানবন্দরে রপ্তানির চাপ বেড়েছে। ফলে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে কার্গো চালুর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, তবে তা সম্পূর্ণ কার্যকর হওয়ার আগেই ব্যবসায়ীরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, “আকাশপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে যে সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত, শাহজালালে তা নেই। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে পণ্য বাণিজ্যে সমস্যা অনেক কমবে। তবে তা কার্যকর হওয়ার আগে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের মান বাড়ানো জরুরি।”
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ)-এর সাবেক সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, “এয়ার কার্গো পরিবহন ব্যয়সাশ্রয়ী করতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশের বিমানবন্দরগুলোতে নিজস্ব লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানো গেলে ব্যবসায়ীরা দ্রুত ও নিরাপদভাবে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে।”
সাবেক বেবিচক চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, “ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল হওয়ায় শাহজালালে চাপ বেড়েছে। সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে কার্গো ফ্লাইট চালু হলে চাপ কমবে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে দেশের সব কার্গোপণ্য এখান থেকেই সরবরাহ করা সম্ভব হবে।”
অবকাঠামো ও আধুনিকায়নের প্রয়োজন
১৯৮০ সালে শাহজালাল বিমানবন্দর চালু হওয়ার পর গুদাম ও কার্গো সুবিধা তেমন উন্নয়ন হয়নি। প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০টি ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে, যার মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫টি ফ্লাইটে প্রতিদিন প্রায় ৪শ টন পণ্য আসে। এই পণ্যের মধ্যে কুরিয়ার সার্ভিস, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ পণ্য এবং শুল্ক দিয়ে ছাড়কৃত পণ্য অন্তর্ভুক্ত।
কার্গো গুদামে স্থানসংকট, দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব থাকায় ব্যবসায়ীরা দিনের পর দিন ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে আধুনিকায়ন, দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা না হলে দেশের রপ্তানি ও আমদানি খাত মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
বেবিচক জানাচ্ছে, তৃতীয় টার্মিনালে নতুন অত্যাধুনিক কার্গো গুদাম ডিসেম্বর থেকে চালু হবে। সেক্ষেত্রে পণ্য বাণিজ্যে সমস্যা কমবে। পাশাপাশি সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিমানবন্দরগুলোতে কার্গো সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। পোর্ট হ্যান্ডলিং চার্জ ও কার্গো পরিবহন ভাড়া কমিয়ে দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর হলে বাংলাদেশের এয়ার কার্গো খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া দ্রুত ও নিরাপদ হবে, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা শক্তিশালী হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে