
ছবি: সংগৃহীত
তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনের প্রান্তে এক বিরল দৃশ্য দেখা গেল। বিশ্বের তিন প্রভাবশালী নেতা—চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন—একসঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে করমর্দন ও বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপচারিতায় মেতে উঠলেন। বৈশ্বিক রাজনীতির জটিল ও সংঘাতময় সময়ে এই তিন নেতার এমন সখ্যতা বিশ্বরাজনীতিতে নতুন এক সম্ভাবনার বার্তা বহন করছে। সরাসরি সদস্য না হলেও এর ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের মতো আঞ্চলিক দেশগুলোর ওপরও পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার দিকে অগ্রগতি
আন্তর্জাতিক রাজনীতির মেরুকরণ এখন আর আগের মতো একমুখী নয়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিকতার জায়গায় বহুমুখী শক্তির উত্থান স্পষ্ট হচ্ছে। শি-মোদি-পুতিনের এই মেলবন্ধন তারই ইঙ্গিত বহন করছে। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিশ্বে যে বহুপক্ষীয় নতুন ভারসাম্যের খেলা শুরু হয়েছে, তার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হতে যাচ্ছে এশিয়া। চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বাড়বে, যার সুফল স্বভাবতই পাবে বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়া।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশ এখনো এসসিও–এর সদস্য না হলেও কয়েক বছর আগে চীনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের আপত্তির কারণে আলোচনাটি সামনে এগোয়নি। তবে বাংলাদেশ এই আঞ্চলিক জোটে যোগ দিতে আগ্রহী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ভূ-অবস্থান এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এ সংস্থার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শি-মোদি-পুতিনের সখ্য আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব কমাতে পারলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার পথ আরও সহজ হতে পারে।
ভারতের কৌশলগত টানাপোড়েন
মোদি কেন এই সম্মেলনে যোগ দিলেন, তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। গত সাত বছরে এটাই মোদির প্রথম চীন সফর। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কবিষয়ক অচলাবস্থা ভারতের জন্য চাপ তৈরি করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় রপ্তানির প্রতিযোগিতা শক্তভাবে ধাক্কা খেয়েছে। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপে হতবাক হয়েছেন মোদি, যিনি আগে প্রবাসী ভারতীয়দের ভোটে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দেওয়ার জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা ভারতের কৌশল হতে পারে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প যদি ছাড় দেন, মোদি কি আবার মার্কিন ঘরানায় ফিরে যাবেন?
চীন-ভারত সম্পর্কের অনিশ্চয়তা
চীন ও ভারতের সম্পর্ক বরাবরই টানাপোড়েনপূর্ণ। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলএসি) সংঘাত, গ্যালভান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের দাবি—এসব কারণে দুই দেশের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস বিদ্যমান। এমনকি দালাইলামার অবস্থান নিয়েও দুই দেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত থাকে। ফলে শি-মোদির সাম্প্রতিক বন্ধুত্বপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি অনেককে আশাবাদী করলেও অনেকে সন্দিহান। কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই; জাতীয় স্বার্থই স্থায়ী—এই বাস্তবতা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
মিয়ানমার ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা
বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার গৃহযুদ্ধ ও অস্থিতিশীলতায় জর্জরিত। সেখানে চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক যদি ঘনিষ্ঠ হয়, তবে মিয়ানমার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ কমে আসতে পারে। এতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বাড়বে এবং সরাসরি উপকৃত হবে বাংলাদেশ। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পশ্চিমা চাপ কমলে চীন ও ভারতের সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুলতে পারে।
রাশিয়ার ভূমিকা
রাশিয়া বরাবরই ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র। রাশিয়া থেকে অস্ত্র ও তেল আমদানি ভারতের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারত রাশিয়া থেকে অশোধিত তেল আমদানি করে ৩৯ মাসে ১২৬০ কোটি ডলারের বেশি মুনাফা করেছে। এর জেরে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়ে শুল্ক আরোপ করেন। তবুও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। পুতিন ও মোদির এই সম্পর্কই শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ত্রিমুখী সমীকরণকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করছে।
এসসিওর বিস্তার ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
২০০১ সালে চীনের উদ্যোগে গঠিত এসসিও শুরুতে সীমিত আঞ্চলিক সহযোগিতার সংস্থা হলেও এখন তা বৈশ্বিক গুরুত্ব পাচ্ছে। শুরুতে কাজাখস্তান, কিরগিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান সদস্য হলেও পরে পাকিস্তান, ভারত, ইরান ও বেলারুশ এতে যোগ দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ না দিলেও এর কার্যক্রমে গভীর আগ্রহ দেখাচ্ছে। নতুন সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা আবার আলোচনায় আসতে পারে।
উপসংহার
শি-মোদি-পুতিনের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতা কেবল একটি সম্মেলনের প্রটোকল নয়; বরং এটি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদিও চীন-ভারত সম্পর্কের ইতিহাস টানাপোড়েনময়, তবুও যদি তারা সত্যিই কাছাকাছি আসে, তবে বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়া স্থিতিশীলতার সুফল পাবে। বিশেষ করে মিয়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সংকট, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা—সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে। তবে এই সখ্য কতটা স্থায়ী হবে, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ