
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নতুন উদ্যোগ। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে প্রণীত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)–এর খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে এমন একটি বিধান, যার ফলে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইসির চূড়ান্ত অনুমোদিত খসড়া অনুযায়ী, আদালত কর্তৃক কেউ যদি ফেরারি আসামি হিসেবে ঘোষিত হন, তবে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য থাকবেন না।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সময় পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। সেদিন রাজধানী ঢাকায় লাখো মানুষের অগ্নিঝরা আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ভেঙে পড়ে। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। জানা গেছে, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারসহ অনেক শীর্ষ নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বিচারাধীন।
নিয়ম অনুযায়ী, আসামিরা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে আত্মগোপনে থাকেন, তবে আদালত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাদের ফেরারি ঘোষণা করে। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ অনেকের নাম আদালতের বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ আইনি দিক থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রচলিত নিয়মে কোনো ব্যক্তি আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে নির্বাচন করার অযোগ্য হতেন। কিন্তু নতুন প্রস্তাবিত বিধান অনুসারে, রায়ের আগেই যদি কোনো আসামিকে আদালত ফেরারি ঘোষণা করেন, তবে সেখানেই শেষ হয়ে যাবে তার নির্বাচনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা। এভাবে মামলার রায় ঘোষণার আগেই আসামির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আটকে যাবে।
তাছাড়া এতদিন প্রার্থী বা তার প্রস্তাবক অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ পেতেন। কিন্তু নতুন প্রস্তাবে অনলাইনের এই সুবিধা তুলে দিয়ে সরাসরি রিটার্নিং কর্মকর্তা বা সহকারী কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। ফলে বিদেশে বা গোপনে থাকা কোনো প্রার্থী এ সুবিধা নিতে পারবেন না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে নানা মামলা চলমান থাকায় এবং তাদের অনেককে ইতোমধ্যে আদালত ফেরারি ঘোষণা করায়, তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা হারাবেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগে যেসব মামলা চলমান আছে, সেখানে ফেরারি আসামিদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
তবে এ বিষয়ে কিছু শঙ্কাও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ফেরারি আসামিকে নির্বাচনে অযোগ্য করার এই বিধান যদি প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার হয়, তবে তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানিয়েছেন, দীর্ঘ আলোচনা শেষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “আদালত কর্তৃক ফেরারিরা নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার বিধান আমাদের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে রেখেছি। যদিও এর অপব্যবহার হতে পারে বলে পূর্বে মন্তব্য করা হয়েছিল, তবে সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করে আমরা মনে করেছি এটি প্রয়োজনীয়।”
তিনি আরও জানান, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এতে করে প্রকৃত প্রার্থীকে সরাসরি হাজির হয়ে প্রার্থী হতে হবে।
ইসির অনুমোদিত খসড়ায় আরও কিছু বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন—
-
কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে সেখানে ‘না ভোট’ দেওয়ার বিধান।
-
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ও কোস্টগার্ড যুক্ত করা।
-
প্রার্থীর হলফনামায় দেশে-বিদেশে থাকা সব সম্পদ প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা। মিথ্যা তথ্য দিলে নির্বাচিত হওয়ার পর তার সংসদ-সদস্য পদ বাতিল করা যাবে।
-
জামানত ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ।
-
জোটভুক্ত প্রার্থীরা নিজ নিজ দলীয় প্রতীকে ভোট করবেন।
-
পোলিং এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর নিজ নির্বাচনি এলাকার ভোটার হতে হবে।
-
পুরো আসনের ভোট বাতিল করার ক্ষমতা আবারও ইসির হাতে ফিরিয়ে আনা।
-
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার সংক্রান্ত সব অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া।
ইসির অনুমোদনের পর খসড়াটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে। সেখানে অনুমোদন শেষে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তা তোলা হবে। এরপর অধ্যাদেশ জারি হলে নতুন বিধান কার্যকর হবে।
বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য এই পরিবর্তনগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে নাটকীয় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা ও ফেরারি ঘোষণা তাদের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করবে। অন্যদিকে, ইসির এই পদক্ষেপকে অনেকে স্বাগত জানালেও, অপব্যবহারের আশঙ্কা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ