
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভবিষ্যতে আর কখনোই ভোটার ও এজেন্টশূন্য নির্বাচন আয়োজন করতে দিতে চায় না। এ লক্ষ্যেই নানা ধরনের সংস্কার ও বিধি-নিষেধ সংযোজন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কমিশনের নীতি, পদক্ষেপ ও নতুন পরিবর্তনসমূহ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
ভোটার-এজেন্টবিহীন নির্বাচন আর নয়
ইসি সানাউল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেন, “ভোটার ও এজেন্টবিহীন নির্বাচন যাতে বাংলাদেেশে আর না হয়, সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছি। এবার থেকে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রকে কার্যত জীবন্ত রাখার মতো ব্যবস্থা থাকবে।” তিনি আরও যোগ করেন, কমিশনের লক্ষ্য হলো এমন একটি প্রক্রিয়া তৈরি করা যেখানে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্র, প্রিসাইডিং অফিসার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এজেন্টরা সমন্বিতভাবে কাজ করবেন।
অনলাইনে মনোনয়ন দাখিল বাতিল
নির্বাচন প্রক্রিয়ার বড় পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধান বাতিল করা। সানাউল্লাহ জানান, “এবার থেকে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র সরাসরি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিতে হবে। আরপিও থেকে অনলাইনে মনোনয়ন দাখিলের বিধান সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।” এর ফলে মনোনয়ন যাচাইয়ে স্বচ্ছতা ও সরাসরি জবাবদিহিতা আরও জোরদার হবে বলে কমিশনের আশা।
প্রিসাইডিং অফিসারের পূর্ণ ক্ষমতা
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবার থেকে প্রিসাইডিং অফিসারকে সর্বাত্মক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। কোনো ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, সেটি বন্ধ বা চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তিনি। একইসঙ্গে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের হাতে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত হলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থায়
অতীতে সেনা মোতায়েন নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও এবার আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তালিকায় আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করা হয়েছে। সানাউল্লাহ জানান, “ভোটের দিন নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীও সরাসরি ভূমিকা পালন করবে।”
রাজনৈতিক প্রতীক ও দলীয় অবস্থান
নির্বাচনী প্রতীক প্রসঙ্গে কমিশনার বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম স্থগিত থাকলে তাদের প্রতীকও স্থগিত থাকবে এবং সেই দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তবে প্রতীক ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়াতে পারবেন কি না—সেটি সময়মতো নির্ধারিত হবে। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন হলে প্রার্থীরা নিজ নিজ দলের প্রতীকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলেও তিনি স্পষ্ট করেন।
মিথ্যা তথ্য দিলে বাতিল হবে সংসদ সদস্য পদ
হলফনামায় প্রার্থীদের সঠিক তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদি কোনো প্রার্থী ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য গোপন করেন বা মিথ্যা তথ্য দেন, তবে নির্বাচিত হওয়ার পরও তার সংসদ সদস্য পদ হারাতে হতে পারে। সানাউল্লাহ জানান, “ইসি প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেবে, এবং আদালতও প্রয়োজনীয় রায় দিতে পারবে।”
নির্বাচনে অযোগ্য হবেন কারা
আইন অনুযায়ী, আদালত কর্তৃক ‘ফেরারি’ ঘোষিত ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। একইসঙ্গে যেসব ব্যক্তি ‘লাভজনক পদে’ আছেন—অর্থাৎ সরকারি মালিকানায় ৫০ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ার রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত—তারাও প্রার্থী হতে পারবেন না।
ইভিএম বাতিল, নতুন করে পোস্টাল ব্যালট
দীর্ঘ বিতর্কের পর এবার ইভিএম পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। সানাউল্লাহ জানান, “আগামী জাতীয় নির্বাচনে আর কোনো আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। সব আসনেই কাগজের ব্যালট ব্যবহার হবে।” এছাড়া এবার পোস্টাল ব্যালটে প্রতীকের ব্যালট ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জামানত বৃদ্ধি ও ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা
প্রার্থীদের জামানত অর্থ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কমিশনার বলেন, “এটি প্রার্থীদের গুরুত্ব ও দায়বদ্ধতা বাড়াতে সহায়ক হবে।” আর কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ব্যালটে ‘না’ ভোটের অপশন রাখা হবে, যাতে ভোটারদের মতামত প্রতিফলিত হয়।
সামগ্রিক লক্ষ্য
নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহর বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে—এবারের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ও ভোটের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। ভোটার, এজেন্ট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রিসাইডিং অফিসারদের সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোট যেন সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক উৎসবে পরিণত হয়, সে লক্ষ্যেই কাজ করছে কমিশন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ