
ছবি: সংগৃহীত
বেনাপোল স্থলবন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল স্থলবন্দরে বাংলাদেশগামী পাঁচটি ট্রাক জব্দ করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও কাস্টমস। সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) সকালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে প্রায় ১৫ কোটি টাকার বিভিন্ন পণ্য জব্দ করা হয়। ভারত সরকারের অর্থনৈতিক গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এ অভিযানে অংশ নেয়। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে সময় লাগলেও বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) বন্দরে খবর ছড়িয়ে পড়লে দুই দেশের ব্যবসায়িক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের আমদানি-রপ্তানিকারকরা এ ঘটনায় ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ব্যবসায়ী মহলের ধারণা, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে ভবিষ্যতে পেট্রাপোল বন্দরে আরও কঠোর নজরদারি শুরু হতে পারে। এতে নিয়মিত রপ্তানি প্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে, আমদানি-রপ্তানির ব্যয় বাড়বে এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে।
ভারতীয় ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, আটককৃত পণ্যের বাংলাদেশি মালিক বেনাপোলের বহুল আলোচিত আমদানিকারক হাসানুজ্জামান হাসান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসানের প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামান ট্রেডার্স ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে এ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।
ভারতীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মেসার্স রুহানী এন্টারপ্রাইজ, সোহানী এন্টারপ্রাইজ ও তাহানি এন্টারপ্রাইজ নামের কোম্পানি, যেগুলো কুতুব মণ্ডল ও তার মণ্ডল গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাগজপত্রে মোটরসাইকেলের পার্টস দেখানো হলেও ট্রাকে ছিল উচ্চমূল্যের ভিন্ন ভিন্ন পণ্য।
ভারতীয় কাগজপত্রে ঘোষণায় বলা হয়েছে, ১৬টি চালান মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ। কিন্তু ট্রাকগুলোতে পাওয়া গেছে ওষুধ, জিলেট ব্লেড, শেভিং ট্রিমার, শাড়ি, ফেব্রিক্স, নকল গহনা, মূর্তি, হাতঘড়ি, চাদর, তালা, থ্রি-পিস, জুতা, সেলুন সামগ্রীসহ নানা বিলাসপণ্য। এসব পণ্যের বৈধ কোনো নথিপত্র ভারতীয় কাস্টমসের কাছে উপস্থাপন করা যায়নি। ভারতীয় সূত্র দাবি করছে, এইসব ভুয়া চালানের আড়ালে বহু বছর ধরে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে রপ্তানি চালানো হচ্ছে।
ভারতীয় ব্যবসায়ী মহলের অভিযোগ, মণ্ডল গ্রুপের হাতে থাকা পাঁচটি রপ্তানি লাইসেন্সের মধ্যে কেবল একটি বৈধ, বাকি চারটি ভুয়া। ভুয়া লাইসেন্স ব্যবহার করে তারা অবৈধ রপ্তানি চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল পার্টস রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতীয় সরকার যে প্রণোদনা দেয়, সেটি কাজে লাগিয়ে প্রকৃত মোটর পার্টস না পাঠিয়ে অন্য পণ্য পাঠানো হতো। ফলে তারা দ্বিগুণ সুবিধা পাচ্ছিল—একদিকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে বিলাসপণ্য পাঠিয়ে বিপুল লাভ, অন্যদিকে সরকারের কাছ থেকে বৈধ প্রণোদনা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আটককৃত পণ্যের মালিক হাসানুজ্জামান হাসান হলেন বেনাপোল পোর্ট থানার পুটখালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হাদিউজ্জামানের ভাই। শুধু তিনিই নন, সীমান্ত এলাকায় আজিমসহ আরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের কাস্টমস ও বন্দরের দুর্নীতিগ্রস্ত অংশীদারদের সহযোগিতায় রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই অবৈধ বাণিজ্যে কিছু কাস্টমস কর্মকর্তা ও বন্দরের কর্মচারীর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। ফলে ভুয়া ঘোষণার আড়ালে কোটি কোটি টাকার পণ্য নির্দ্বিধায় বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
ভারতের কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, বেনাপোল বন্দরের কিছু শেড ইনচার্জ, আইআরএম টিম এবং শুল্ক গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় এসব অবৈধ চালান ঢুকত। পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী ট্রাক ঢোকার পর আইআরএম টিম নামমাত্র পরীক্ষা করত। বড় অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে পণ্য খালাস হয়ে যেত।
সম্প্রতি কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন বেনাপোল কাস্টম হাউজে যোগ দেওয়ার পর থেকে দুর্নীতি রোধে পদক্ষেপ নিলেও পুরোনো প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের কারণে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বেনাপোল বন্দরের একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তে সক্রিয় একটি চক্র অবৈধ পণ্য বৈধ কাগজপত্রের আড়ালে দেশে আমদানি করছে। এতে রাজস্বের কোটি কোটি টাকা ফাঁকি যাচ্ছে। এর পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়া, কাস্টমস ও বন্দরের ভেতরে থাকা কিছু প্রভাবশালী মহল এবং উভয় দেশের অসাধু ব্যবসায়ী সক্রিয় রয়েছে।
রপ্তানি পণ্য আটকের ঘটনায় অভিযুক্ত আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টম হাউজের ইনভেস্টিগেশন রিসার্চ ম্যানেজমেন্ট (আইআরএম) বিভাগের উপ-কমিশনার রাফেজা সুলতানা বলেন, “শুনেছি ভারতে বড় একটি পণ্য চালান আটক হয়েছে। তবে এখনও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তথ্য পাইনি। তথ্য হাতে পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত বাণিজ্যে নতুন করে চাপ তৈরি হতে পারে। পেট্রাপোল ও বেনাপোল দিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক যাতায়াত করে। তার মধ্যে কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে যদি কড়াকড়ি বাড়ানো হয়, তবে বৈধ ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে