
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই মাসকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মোড় ঘোরানো সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশব্যাপী সেই আন্দোলনের ঢেউ শুধু দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে। প্রবাসীরা নানা জায়গা থেকে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন, কেউ সরাসরি আন্দোলনে যোগ দিতে দেশে এসেছিলেন, কেউ বা বিদেশ থেকেই আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহায়তা দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিলেন। এই প্রবাসী ভূমিকা ও তাদের সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশি অডিও-ভিজ্যুয়াল গল্পকার আশিষ কিফায়েত, তার নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র ‘আমাদ’স ড্রিম’-এ।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মাননা
৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের এই তথ্যচিত্রটি এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য সাড়া ফেলেছে। ‘আমাদ’স ড্রিম’ আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে ইস্তাম্বুলের মর্যাদাপূর্ণ আনাতোলিয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। শুধু তাই নয়, ছবিটি ইস্ট ভিলেজ নিউ ইয়র্ক চলচ্চিত্র উৎসব এবং এথেন্স আন্তর্জাতিক আর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সম্মানসূচক পুরস্কারও অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর এমন অভ্যর্থনা বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিচালক আশিষ কিফায়েত এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “একজন প্রবাসী সদস্য হিসেবে, গত বছরের জুলাই বিপ্লবে প্রবাসীদের অবদানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করছি। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক, পরিচালক এবং প্রযোজকদের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া আমার জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।”
প্রবাসী জীবনের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক মেলবন্ধন
‘আমাদ’স ড্রিম’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র আমাদ মাহবুব, একজন বাংলাদেশি নারী, যিনি সামাজিক নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন স্নায়ুবিজ্ঞানে। তথ্যচিত্রটি দেখায় তার সংগ্রামী যাত্রা, যেখানে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ, সাংস্কৃতিক শিকড়ের প্রতি টান এবং রাজনৈতিক সচেতনতা এক সুতোয় গাঁথা হয়ে ওঠে।
তার জীবনে শিল্প, বিশেষ করে মেহেদী নকশা এবং কত্থক নৃত্য একধরনের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের রূপ নেয়। নির্বাসিত জীবনে এই ঐতিহ্যগুলো কেবল শখের শিল্পকর্মে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এগুলো হয়ে উঠেছে তার জন্য সাংস্কৃতিক অস্ত্র, মাতৃভূমির সঙ্গে সংহতির প্রতীক। ছবিতে শিল্পের এই প্রতীকী ব্যবহার প্রবাসী জীবনের জটিলতাকে তুলে ধরে—যেখানে ভৌগোলিক দূরত্ব থাকলেও হৃদয়ের টান মাতৃভূমির সঙ্গেই রয়ে যায়।
রাজনৈতিক বার্তা ও জুলাই বিপ্লব
তথ্যচিত্রটি কেবল একটি নারীর সংগ্রাম বা প্রবাসী জীবনের গল্প নয়, বরং এটি প্রতিফলিত করে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় প্রবাসীদের ভূমিকা। ওই সময়ে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি প্রবাসীরা নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, কেউ অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছেন, আবার কেউ তাদের পেশাগত দক্ষতাকে আন্দোলনের পক্ষে কাজে লাগিয়েছেন।
ছবিটি সেই বাস্তবতাকে শিল্পকলা ও প্রতীকী ভাষায় তুলে ধরে। এতে দেখানো হয়েছে কীভাবে আমাদ তার মেহেদী শিল্পকে গণআন্দোলনের প্রতি সংহতির এক রূপ হিসেবে ব্যবহার করেন। তার শিল্পকর্ম একদিকে যেমন ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির প্রতীক, তেমনি অন্যদিকে তা হয়ে ওঠে একটি জাতীয় সংগ্রামের অংশ। এটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে যে, প্রবাসীরা কেবল দূর থেকে দর্শক হয়ে থাকেননি, বরং তারা নানা কৌশলে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন।
প্রবাসীদের সংগ্রাম ও আন্তর্জাতিক অভ্যর্থনা
চলচ্চিত্রটির অন্যতম শক্তি হলো এর দ্বিমুখী বার্তা—একদিকে এটি ব্যক্তিগত গল্প বলে, অন্যদিকে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক দর্শকরা এই দ্বিমুখী দিকটিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। অনেকে এটিকে এক ধরনের “সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের দলিল” বলে অভিহিত করেছেন।
সমালোচকদের মতে, ‘আমাদ’স ড্রিম’ প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশি প্রবাসীদের জীবন কেবলমাত্র প্রবাসী বাস্তবতায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন, সক্রিয় এবং তাদের শিল্প-সংস্কৃতি দিয়ে আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা গড়ে তুলতে সক্ষম।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন দিগন্ত
স্বল্পদৈর্ঘ্য হলেও ‘আমাদ’স ড্রিম’ এর মধ্য দিয়ে আশিষ কিফায়েত বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। একদিকে এটি প্রামাণ্যচিত্র, অন্যদিকে এটি শিল্প-সংস্কৃতির কাব্যিক রূপক। প্রবাসী বাংলাদেশিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপন করা এবং সেইসঙ্গে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন—এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এক সাহসী পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ