
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ববাজারে আবারও স্বর্ণের দামে লেগেছে রেকর্ড ভাঙার ছোঁয়া। নিরাপদ বিনিয়োগের প্রধান ভরসা হিসেবে পরিচিত এই মূল্যবান ধাতুটি হঠাৎ করেই চড়া দামে লেনদেন হতে শুরু করেছে। সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছুঁয়েছে ৩ হাজার ৫৭৮ দশমিক ৫০ ডলারের নতুন মাইলফলক। ইতিহাসে এর আগে এত উচ্চ মূল্যে স্বর্ণ লেনদেন হয়নি।
স্বর্ণের বাজারে একের পর এক রেকর্ড
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববাজারে স্পট স্বর্ণের দাম এক দিনে বেড়েছে প্রায় ১ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে প্রতি আউন্সের দাম দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৭৬ দশমিক ৫৯ ডলার। অল্প সময়ের ব্যবধানেই এটি ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫৭৮ দশমিক ৫০ ডলারের শিখরে পৌঁছে যায়। শুধু স্পট মার্কেটই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ফিউচার মার্কেটেও স্বর্ণের দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬৩৫ দশমিক ৫০ ডলার।
এতে করে একদিকে যেমন বিনিয়োগকারীরা নতুন করে উৎসাহিত হচ্ছেন, অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতা ও স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। কারণ, দাম এত দ্রুত বাড়তে থাকলে অলঙ্কার বাজারে চাহিদা আরও হ্রাস পাবে।
কেন হঠাৎ দাম বাড়ছে?
স্বর্ণের দাম বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক তথ্যগুলো বাজারে বড় প্রভাব ফেলেছে। জুলাই মাসে দেশটিতে চাকরির সুযোগ প্রত্যাশার তুলনায় অনেক বেশি হারে কমেছে। পাশাপাশি নতুন নিয়োগও ছিল সীমিত। এর ফলে শ্রমবাজারে যে চাপ রয়েছে, তা কমে আসছে—এমন ইঙ্গিত মিলেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই তথ্যগুলো ফেডারেল রিজার্ভকে (ফেড) সুদের হার কমানোর পথে হাঁটতে আরও উৎসাহিত করবে। সেপ্টেম্বর মাসে ফেডের বৈঠকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট সুদহার কমানো হবে—এমন সম্ভাবনা এখন প্রায় নিশ্চিত। সিএমই গ্রুপের ফেডওয়াচ টুল বলছে, এ সম্ভাবনা বর্তমানে ৯৮ শতাংশ, যেখানে আগে এটি ছিল ৯২ শতাংশ।
সুদহার কমানোর প্রত্যাশা সব সময়ই স্বর্ণের জন্য ইতিবাচক। কারণ সুদের হার কমলে অন্যান্য বিনিয়োগ কম লাভজনক হয়ে পড়ে, অথচ স্বর্ণে বিনিয়োগ তখন তুলনামূলক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বাজার বিশ্লেষক ফাওয়াদ রাজাকজাদা বলেন, “চাকরির তথ্য প্রকাশের আগেই স্বর্ণের দাম রেকর্ড গড়েছিল। নতুন পরিসংখ্যান দুর্বল আসায় দাম আরও দ্রুত বেড়েছে। এখন পরবর্তী লক্ষ্যমাত্রা হবে প্রতি আউন্স ৩ হাজার ৬০০ ডলার।”
অন্যদিকে জ্যানার মেটালসের সিনিয়র কৌশলবিদ পিটার গ্রান্ট মনে করেন, স্বর্ণের ঊর্ধ্বমুখী ধারা শুধু স্বল্পমেয়াদে নয়, মধ্যমেয়াদেও অব্যাহত থাকতে পারে। তার ভাষায়, “আগামী কয়েক মাসে দাম ৩ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ ডলারের মধ্যে উঠতে পারে। এমনকি আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকের শেষে স্বর্ণ ৪ হাজার ডলারের মাইলফলক ছুঁতে পারে।”
হেরিয়াস মেটালসের ব্যবসায়ীরা ভিন্ন একটি দিক তুলে ধরেছেন। তাদের মতে, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে যে ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা ডলারভিত্তিক সম্পদের ওপর আস্থা কমাচ্ছে। এর ফলেই বিনিয়োগকারীরা ক্রমেই স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছেন।
ট্রাম্প বনাম ফেড
স্বর্ণের দাম বাড়ায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও কিছুটা দায়ী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশ্যে ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলকে সমালোচনা করে আসছেন। তার দাবি, ফেড যদি আগেই সুদহার কমাত, তাহলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। অন্যদিকে ফেড গভর্নর ক্রিস্টোফার ওয়ালার সম্প্রতি স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি সুদহার কমানোর পক্ষে হলেও প্রক্রিয়ার গতি নির্ভর করবে অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থার ওপর।
এই দ্বন্দ্বের কারণে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি অনিশ্চয়তায় পড়ছেন। অনিশ্চয়তা বাড়লে যে সম্পদে সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখা হয়, সেটি হলো স্বর্ণ।
ইউরোপেও ধীরগতি
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপের অর্থনীতিও স্বর্ণের দাম বাড়াতে সহায়তা করছে। ইউরোজোনের অর্থনীতি আগস্ট মাসে খুবই ধীরগতিতে প্রসারিত হয়েছে। অর্থনীতির এই মন্থরতা এবং কম সুদহারের পরিবেশ স্বর্ণে বিনিয়োগের আকর্ষণ আরও বাড়িয়েছে।
শুধু স্বর্ণ নয়, অন্য ধাতুতেও প্রভাব
স্বর্ণের দামের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর দামও বেড়েছে। স্পট সিলভার ১ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৩৪ ডলারে, যা ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ। প্লাটিনামের দাম বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৩৪ দশমিক ১৭ ডলার এবং প্যালাডিয়ামের দর উঠেছে ১ হাজার ১৫৫ দশমিক ০৫ ডলারে।
এটি স্পষ্ট যে, শুধু স্বর্ণ নয়, গোটা মূল্যবান ধাতুর বাজারেই এক ধরনের উর্ধ্বমুখী ধারা তৈরি হয়েছে।
ভবিষ্যৎ চিত্র
বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামনের দিনগুলোতে স্বর্ণের দাম আরও বাড়তে পারে। ফেড যদি সত্যিই সুদহার কমায়, তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে স্বর্ণের দাম ৪ হাজার ডলারের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
সব মিলিয়ে স্বর্ণ এখন শুধু একটি ধাতু নয়, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে ক্রেতাদের জন্য এটি বাড়তি বোঝা, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের কাছে স্বর্ণ এখন নিরাপদ আশ্রয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ