
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলের তীব্র বোমাবর্ষণে একদিনে কমপক্ষে ৭৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কেবল গাজা সিটিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৩ জন। হামাস ও স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় পুরো পরিবারকেও টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। এই ঘটনাকে হামাস “গণহত্যা” আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে।
পরিস্থিতি ভয়াবহ: পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন
গাজা শহরের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ইসরায়েলি হামলার ফলে একটি পরিবারের সবাইকে একসাথে হত্যা করা হয়েছে। সাবরিন আল-মাবহুহ বলেন, “আমার ভাইকে তার ঘরেই হত্যা করা হয়েছে। তার স্ত্রী-সন্তানসহ সবাইকে মুছে দিয়েছে। কেউ বেঁচে নেই।”
শেখ রাদওয়ান এলাকায় স্কুলে আশ্রয় নেওয়া মানুষের তাঁবুতে ইসরায়েলি গ্রেনেডে আগুন ধরে যাওয়ার পর জাকিয়া সামি বলেন, “শেখ রাদওয়ান জ্বলছে। যদি গাজা সিটির দখল থামানো না হয়, আমরা মরে যাব। যারা শুধু দেখছে, কিছু করছে না— তাদের আমরা ক্ষমা করব না।”
অবরোধ ও খাদ্য সংকট: মানবিক বিপর্যয়
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অবরোধের কারণে খাদ্য ও সহায়তা প্রবেশে কড়াকড়ি থাকায় এক শিশুসহ আরও ছয়জন অপুষ্টি ও অনাহারে মারা গেছে। চলমান অবরোধে এখন পর্যন্ত ক্ষুধাজনিত কারণে ৩৬৭ জন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন, এর মধ্যে ১৩১ শিশু। খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক সংস্থা আইপিসি জানিয়েছে, উত্তর গাজায় ইতিমধ্যেই দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে এবং তা দ্রুত দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, ইসরায়েলের গাজা সিটি দখল অভিযান প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করতে পারে। শুধু ১৪ থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে জোরপূর্বক ৮২ হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩০ হাজারকে উত্তর থেকে দক্ষিণে সরানো হয়েছে। ইউনিসেফ সতর্ক করেছে, ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ পাঁচ বছরের নিচের ১ লাখ ৩২ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়বে। বর্তমানে ৩ লাখ ২০ হাজার শিশু ভয়াবহ ক্ষুধার মুখে রয়েছে।
ধ্বংসযজ্ঞ: অবকাঠামো ও আবাসিক এলাকা
গাজার গণমাধ্যম দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গাজা সিটিতে গত তিন সপ্তাহে কমপক্ষে ১০০ রোবট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরো আবাসিক ব্লক ও মহল্লা গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। ১৩ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া অভিযানে গাজা সিটিতেই মারা গেছেন প্রায় ১ হাজার ১০০ ফিলিস্তিনি। গাজার সাংবাদিক হানি মাহমুদ বলেন, “পরিস্থিতি প্রলয়ংকরী রূপ নিয়েছে। পুরো মহল্লা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। মানুষ কয়েক দশকে যা গড়ে তুলেছিল, সব হারাচ্ছে। এটা যেন এক দুঃস্বপ্ন।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবিক আহ্বান
হামাস জানিয়েছেন, তারা একটি সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতি চায় এবং ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে সব ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত। এ বিষয়ে আল জারিসি পরিবারের বাসায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছে। হামাস এটিকে “ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ” আখ্যা দিয়েছে।
আল জাজিরা জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের “গণহত্যা” বন্ধে অবিলম্বে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। ইউনিসেফ এবং আইপিসি সতর্ক করেছে, শিশুদের জীবন রক্ষায় বিশেষ পুষ্টি সহায়তা, খাদ্য ও জরুরি মানবিক সহায়তা অবিলম্বে প্রদান করা প্রয়োজন।
গাজা বাঁচানোর জন্য মানবিক হুমকি
স্থানীয়দের মতে, ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধের কারণে প্রতিদিন টিকে থাকা ফিলিস্তিনিদের জন্য এক ধরনের সংগ্রাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকা মানুষ খাদ্যের অভাব ও বোমা হামলার ভয় মোকাবিলা করছে। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় মানবিক বিপর্যয় দিন দিন গভীর হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গাজার বর্তমান পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন লঙ্ঘনের প্রতীক। বিশ্ব সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘের অবিলম্বে হস্তক্ষেপ ছাড়া ফিলিস্তিনিরা ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর মুখোমুখি হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ