
ছবি: সংগৃহীত
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত “জুলাই জাতীয় সনদ” নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রস্তাবিত এই সনদকে ঘিরে প্রথম থেকেই নানা আলোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দলের সই পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে এখন দেখা দিয়েছে তীব্র সংশয়। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর) পদ্ধতি, নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন, এবং সনদ বাস্তবায়নের ধাপ ও প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর বিভক্তি তৈরি হয়েছে। এর ফলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিজেই এখন দোলাচলে পড়েছে—সবার সই করিয়ে সনদ চূড়ান্ত করা আদৌ সম্ভব হবে কি না।
কমিশনের অচলাবস্থা
চলতি সপ্তাহেই সনদের চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণের পরিকল্পনা থাকলেও কমিশন তা করতে পারেনি। ইতিমধ্যে প্রায় তিন ডজন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে একাধিক আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে কমিশন দলগুলোর মতামত নিয়েছে। প্রাপ্ত সুপারিশমালা পর্যালোচনার জন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্তও হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিভক্তি যতটা প্রকট, তাতে সনদ চূড়ান্ত ও স্বাক্ষরের জন্য স্বস্তিদায়ক কোনো ঐকমত্য এখনও তৈরি হয়নি।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, “সনদের ভাগ্য নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তের ওপর। সবার সই ছাড়া এই সনদ কার্যকর করার স্বপ্ন পূর্ণ হবে না। দলগুলোকেই এগিয়ে এসে নিজেদের অবস্থান নমনীয় করতে হবে।”
রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত
জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মূল কারণ হলো রাজনৈতিক দলের ভিন্ন অবস্থান। জামায়াত ইসলামি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ শুরু থেকেই পিআর পদ্ধতির পক্ষে। তাদের দাবি—সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচন প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশনের ভিত্তিতে হতে হবে। একই সঙ্গে তারা চাইছে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেন, “আমরা চাই জনগণের প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন হোক। গণভোট কিংবা রাষ্ট্রপতির ঘোষণার মাধ্যমে হলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে আমাদের সই দেওয়া সম্ভব নয়।”
অন্যদিকে এনসিপি সরাসরি প্রস্তাব করেছে, আগামী নির্বাচনই যেন গণপরিষদ নির্বাচন হয় এবং সেই সংসদ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও একই প্রস্তাব দিয়েছে এবং দাবি করেছে যে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগ দলই পিআর পদ্ধতির পক্ষে।
তবে বিএনপি শুরু থেকেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। আমাদের জনগণ এখনো ইভিএম প্রক্রিয়াও পুরোপুরি বোঝেনি। এভাবে নতুন পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়া হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।” তিনি অভিযোগ করেন, কিছু দল পরিকল্পিতভাবে অযৌক্তিক প্রস্তাব দিয়ে নির্বাচন বিলম্বিত বা বানচাল করার ষড়যন্ত্র করছে।
বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে একমত হয়েছে আরও কয়েকটি দল—এলডিপি, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং কয়েকটি বামপন্থি দল। এসব দল স্পষ্ট জানিয়েছে, সংবিধানে নেই এমন প্রস্তাব মানা সম্ভব নয়। বরং ভবিষ্যৎ সংসদ থেকেই যে কোনো সংস্কার কার্যকর করতে হবে।
কমিশনের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ২৮টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে এবং ২৬টি দল লিখিত মতামত জমা দিয়েছে। সোমবার ও বুধবার টানা বৈঠকে আরও কয়েকটি দলের মতামত নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরেকটি বৈঠক করে সনদের খসড়া চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে “চূড়ান্ত খসড়া” পাঠানো হবে।
তবে কমিশন জানাচ্ছে, এবার নতুন করে দলগুলোর মতামত নেওয়া হবে না। খসড়া পাঠানোর পর সরাসরি সই করার জন্য একটি ‘স্বাক্ষর অনুষ্ঠান’ আয়োজনের চিন্তা করা হচ্ছে। সেখানে কোন দল সই করবে আর কোন দল বিরত থাকবে, সেটি তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে।
কমিশন আরও জানিয়েছে, জুলাই সনদের মধ্যে বাস্তবায়ন পদ্ধতি উল্লেখ করা হবে না। বরং দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে আলাদা একটি সুপারিশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া হস্তান্তর করা হবে।
বিএনপি বনাম জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন দ্বন্দ্ব
সনদ বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো বিএনপি ও জামায়াত-ইসলামী আন্দোলনের দ্বন্দ্বপূর্ণ অবস্থান। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনের আগেই সনদ বাস্তবায়ন চায়, যেখানে বিএনপি বলছে—এটি পরবর্তী সংসদের দায়িত্ব। এর বাইরে গণভোট ও রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রস্তাব বিএনপি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে।
বিএনপির সোমবারের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এই ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়। দলটির শীর্ষ নেতারা স্পষ্ট করেছেন, “যারা নতুন নতুন প্রস্তাব দিয়ে নির্বাচন ঠেকাতে চাইবে, তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হবে।”
কমিশনের সময়সীমা ও ভবিষ্যৎ
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাস মেয়াদে গঠিত ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৫ আগস্ট। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সেটি এক মাস বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করে। তবে কমিশন আর সময় বাড়াতে চায় না। তাদের পরিকল্পনা, এর মধ্যেই সনদ চূড়ান্ত করে স্বাক্ষর সম্পন্ন করা এবং দায়িত্ব শেষ করা।
স্মর্তব্য, গত ২৯ জুলাই ৩০টি দলকে সনদের প্রাথমিক খসড়া দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৬ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া সরবরাহ করা হয়। এই খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছিল সনদকে সংবিধানের ওপর স্থান দেওয়া এবং আদালতে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না রাখা। বিএনপিসহ এর সমমনা দলগুলো এই প্রস্তাবকে গণতান্ত্রিক বিরোধী আখ্যা দিয়ে কড়া আপত্তি জানায়।
সবশেষ পরিস্থিতি বলছে—জুলাই জাতীয় সনদ ঘিরে এখনও ঐকমত্য তৈরি হয়নি। পিআর পদ্ধতি, গণপরিষদ নির্বাচন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বিভক্ত রাজনৈতিক অবস্থান সনদের ভাগ্যকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত সনদে কতগুলো দল সই করবে, আর কতগুলো দল সরে দাঁড়াবে—তা স্পষ্ট হবে আগামী কয়েক সপ্তাহেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ