
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে তারল্য নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে ধারাবাহিকভাবে নিলামের মাধ্যমে ডলার ক্রয় অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) আবারও নিলামে অংশ নিয়ে ৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ১৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা সমপরিমাণ) কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, বহুমূল্য নিলাম পদ্ধতি (Multiple Price Auction) অনুসরণ করে এই ক্রয় সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে ডলারের কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয় ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা। তিনি বলেন, “আজকের নিলামে ৫টি ব্যাংক অংশ নেয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সেখান থেকে মোট ১৩৪ মিলিয়ন ডলার ক্রয় করেছে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, বহুমূল্য নিলাম পদ্ধতিতে প্রতিটি ব্যাংক তাদের নিজস্ব চাহিদা ও সরবরাহ অনুযায়ী প্রস্তাব জমা দেয়। পর্যালোচনা শেষে কাট-অফ রেট নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার সেই হার নির্ধারিত হয়েছে ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা, যা বর্তমান বাজার বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার কেনার মূল লক্ষ্য হলো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে আরও শক্তিশালী করা এবং বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। গত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময় ডলার বিক্রি করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা ইতিবাচক হওয়ায় আবারও রিজার্ভ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “রিজার্ভের শক্তি বাড়ানো এখন অত্যন্ত জরুরি। কারণ সামনে ঋণ পরিশোধ, উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন এবং আমদানি ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হাতে থাকা দরকার।”
এর আগেও চলতি অর্থবছরে একাধিক দফায় একই ধরনের নিলামের মাধ্যমে ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) নিলামে অংশ নিয়ে ৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ৪৭.৫ মিলিয়ন ডলার ক্রয় করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তারও আগে আরও কয়েক দফায় ডলার কেনা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, “এখন নীতিগতভাবে চেষ্টা হচ্ছে বাজার থেকে ধাপে ধাপে ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়ানো। এতে হঠাৎ করে চাপ সৃষ্টি না হয়ে ধীরে ধীরে মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল থাকবে।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ধরনের নিলাম ডলার বাজারে এক ধরনের আস্থা তৈরি করে। রেমিট্যান্স প্রেরক, রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারকরা বুঝতে পারেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারকে সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করছে। এতে অতিরিক্ত জল্পনা-কল্পনা বা অস্থিরতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, “ডলার বাজারে চাপ কমেছে এবং রিজার্ভ কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে বলেই বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রয় শুরু করতে পেরেছে। তবে এ প্রক্রিয়া চালু রাখতে হলে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত রাখা অপরিহার্য।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে। আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৪২ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি। রপ্তানি খাত থেকেও কিছুটা ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাজার থেকে ডলার কিনে ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষা বলয় তৈরি করছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ৫টি ব্যাংকের কাছ থেকে ১৩৪ মিলিয়ন ডলার কেনার এই পদক্ষেপ কেবল একটি আর্থিক লেনদেন নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার কৌশলের অংশ। ধারাবাহিকভাবে ডলার ক্রয়ের মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়াতে পারলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও স্থিতিশীলতার বার্তা আরও জোরালোভাবে পৌঁছাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ