
ছবি: সংগৃহীত
নেপালে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া জটিল হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের আগেই রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাউডেল ও প্রস্তাবিত প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কীর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। মূলত সংসদ ভাঙার ক্ষমতা কার হাতে থাকবে—এই প্রশ্ন নিয়েই দুই শীর্ষ ব্যক্তির মধ্যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এর ফলে নতুন সরকার গঠনে দেরি হচ্ছে এবং দেশটি আরও অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) নেপালের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম সেতুপাটি জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতি পাউডেল কার্কীকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। তবে তিনি শর্ত দিয়েছেন—কার্কী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই সংসদ ভাঙার সিদ্ধান্ত নেবেন এবং নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন।
রাষ্ট্রপতির দাবি, এ বিষয়ে তিনি ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের রাজি করিয়েছেন। তাদের সমর্থন নিয়েই তিনি সুশীলা কার্কীকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী বানাতে চান।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেছেন, কার্কীকে সংসদ সদস্য হতে হবে না। নেপালের সংবিধানের ৬১ (৪) ধারার অধীনে তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। রাষ্ট্রপতির ভাষায়, “আমার প্রধান দায়িত্ব সংবিধানের রক্ষা ও পালন। সে কারণেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দ্রুত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা জরুরি।”
তবে সুশীলা কার্কী রাষ্ট্রপতির এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। তার বক্তব্য, “প্রথমে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভাঙার ঘোষণা দেবেন, তারপর আমি প্রধানমন্ত্রী হবো।” অর্থাৎ তিনি চান, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরেই তাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হোক, যাতে তার সরকারকে কোনো আইনি জটিলতার মুখে না পড়তে হয়।
কিন্তু রাষ্ট্রপতি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি একতরফাভাবে সংসদ ভাঙতে পারবেন না। সেটা কেবল প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে বৈধ হবে। অন্যথায় আদালত সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারে।
রাষ্ট্রপতি আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন, “আমি নিজে সংসদ ভাঙার পক্ষে নই। অতীতে বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারীও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সংসদ ভেঙেছিলেন। তখনও আমি বলেছিলাম, এভাবে করা সঠিক নয়। সংসদ হলো জনগণের কণ্ঠস্বর, এর ভাঙনের দায় আমি নিতে চাই না।”
বর্তমানে নেপালের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে সেনাবাহিনীর হাতে। সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগ্দেল বৃহস্পতিবার রাতে রাষ্ট্রপতি ও কার্কীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর তিনি সতর্ক করে বলেন, “অধিকার (ক্ষমতা) ছাড়া দীর্ঘদিন সেনা রাস্তায় রাখা সম্ভব নয়। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সেনাবাহিনীও অচলাবস্থার দ্রুত সমাধান চাচ্ছে।
প্রথমদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নতুন প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান এই প্রস্তাবে রাজি হননি। পরবর্তীতে জেনজি প্রজন্মের আন্দোলনের চাপে দলগুলোও সাধারণ মানুষের দাবিকে মেনে নেয় এবং একজন বহিরাগতকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী বানানোর দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেই সূত্রেই সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কীর নাম সামনে আসে।
যদি সুশীলা কার্কী প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে তার সরকারের মূল দায়িত্ব হবে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন। তবে কেবল তাই নয়, তিনি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক কাজ হাতে নিতে চান। এর মধ্যে রয়েছে—
-
৮ ও ৯ সেপ্টেম্বরের জেনজি আন্দোলনের সময়কার সহিংসতার তদন্ত,
-
দুর্নীতির ব্যাপক অনুসন্ধান,
-
রাজনৈতিক নেতাদের সম্পদের খতিয়ান প্রকাশ ও যাচাই,
-
প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
এসব উদ্যোগ তার সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আনতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে নেপালে জেনজি প্রজন্মের নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। দুর্নীতি দমন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা, এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের জবাবদিহির দাবি জানিয়ে হাজারো তরুণ রাজপথে নামে। এরই মধ্যে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৩৪ জন। ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ৯ সেপ্টেম্বর।
ওলির পদত্যাগের পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রশ্নে জটিলতা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রপতি দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করতে চান, কিন্তু প্রস্তাবিত প্রধানমন্ত্রী কার্কী চান আইনি প্রক্রিয়াকে স্পষ্ট করতে। ফলে দুই পক্ষের অচলাবস্থায় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া থমকে গেছে।
বর্তমানে নেপালের পরিস্থিতি অস্থির। সেনাবাহিনী রাস্তায়, রাজনৈতিক দলগুলো দোদুল্যমান, আর জনগণ অপেক্ষা করছে একটি কার্যকরী অন্তর্বর্তী সরকারের। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ও কার্কীর মধ্যে এই মতবিরোধ যত দিন চলবে, তত দিন দেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, দ্রুত সমঝোতায় না পৌঁছালে নেপাল আরও গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ