
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলি বাহিনীর টানা বোমা ও গোলাবর্ষণে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা প্রতিদিনই রক্তাক্ত হয়ে উঠছে। সর্বশেষ বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) দিনভর হামলায় আরও অন্তত ৭২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা দাঁড়াল ৬৪ হাজার ৬০০–এরও বেশি। এ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের খবর প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গাজাজুড়ে ইসরাইলি সেনারা একের পর এক হামলা চালিয়েছে। বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ ও ড্রোন আক্রমণে ধ্বংস হয়েছে একাধিক ভবন, তাঁবু ও শরণার্থী ক্যাম্প। এসব হামলায় অন্তত ৭২ জন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।
তুর্কি বার্তাসংস্থা আনাদোলুর খবরে জানা গেছে, পশ্চিম গাজা শহরে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের অস্থায়ী তাঁবুর ওপর গোলাবর্ষণ চালিয়েছে ইসরাইলি সেনারা। এতে দুটি পরিবার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং অন্তত ১৫ জন প্রাণ হারান। আহতদের অনেকের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুধু তাঁবুই নয়, বেসামরিক মানুষের বসবাসরত বহুতল ভবনও রক্ষা পায়নি ইসরাইলি হামলা থেকে। গাজার পশ্চিমাংশে অবস্থিত টিবা–২ নামের একটি আবাসিক ভবনে বোমাবর্ষণ চালানো হয়। যদিও বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তবুও হামলায় দুইজন নিহত হন। স্থানীয়রা বলছেন, এ ধরনের হামলা মানুষকে আরও আতঙ্কিত করে তুলছে।
গাজার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নাসের স্ট্রিটে একটি তাঁবুতে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় আরও পাঁচজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। অন্যদিকে আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালের কাছে প্যালেস্টাইন স্কোয়ারে আরেকটি তাঁবু লক্ষ্য করে চালানো হামলায় নিহত হন এক বেসামরিক নাগরিক। এতে আহত হন আরও কয়েকজন। হাসপাতালের কাছেই এই হামলা চালানো হওয়ায় স্থানীয়রা বলছেন, চিকিৎসা সেবা নিতে আসা অসংখ্য মানুষের জীবন ছিল ঝুঁকির মুখে।
শেখ রাদওয়ান এলাকায় একত্রিত হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর গোলাবর্ষণ চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এতে একজন নিহত হন। স্থানীয় সূত্র জানাচ্ছে, এ এলাকায় ধারাবাহিক হামলা চলছে, ফলে মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। একইভাবে, মধ্য গাজার বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে এক আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টে বিমান হামলায় নিহত হন একজন এবং আহত হন অনেকে।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলও রক্ষা পায়নি। দেইর আল-বালাহ শহরে এক তাঁবুতে চালানো ড্রোন হামলায় মারা যায় একটি শিশু। এছাড়া খান ইউনিসের জালাল স্ট্রিটে গোলাবর্ষণে প্রাণ হারান চারজন, যাদের মধ্যে দুজনই শিশু। এভাবে প্রতিদিনই নতুন করে শিশু ও নারী নিহত হচ্ছেন, যা গাজার মানবিক সংকটকে আরও গভীর করছে।
আনাদোলুর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় শুরু হওয়া ইসরাইলি অভিযান ইতোমধ্যে প্রাণ কেড়েছে অন্তত ৬৪ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনির। আহত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ধ্বংস হয়েছে হাসপাতাল, স্কুল, আবাসিক ভবন এবং অবকাঠামো। একসময়ের জনবহুল গাজা উপত্যকা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বলছে, ইসরাইলি অবরোধ ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে গাজায় এখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ—সবকিছুরই তীব্র সংকট চলছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইসরাইলি বাহিনী স্পষ্টভাবেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে। বেসামরিক এলাকায় হামলা চালানো, শিশু ও নারীদের হত্যা এবং বাস্তুচ্যুতদের অস্থায়ী আশ্রয় লক্ষ্য করা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আন্তর্জাতিক মহল নিন্দা জানালেও কার্যকর উদ্যোগের অভাবে গাজার মানুষদের দুঃস্বপ্ন প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে।
প্রতিদিন নতুন নতুন মৃত্যুর খবর যুক্ত হচ্ছে গাজার রক্তাক্ত ইতিহাসে। বুধবারের হামলায় আরও ৭২ জন প্রাণ হারানোয় সেখানে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৬৪ হাজার ৬০০–এরও বেশি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা এখন পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রস্থল। আর এ রক্তক্ষয়ী হামলা বন্ধে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ফিলিস্তিনের এই জনপদ আরও দীর্ঘ সময় রক্তাক্ত থাকতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ