
ফাইল ছবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা এখন তুঙ্গে। দীর্ঘ বিরতির পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ভূমিধস জয়ের পর ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমদ নির্বাচনে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি বক্তব্য দেন। সেখানেই তিনি ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন এবং নবনির্বাচিত নেতাদের প্রতি শুভেচ্ছা জানান।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “ডাকসুতে যারা বিজয়ী হয়েছেন, তাদের অভিনন্দন জানাই। এটা গণতন্ত্রের রীতি। গণতন্ত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশাপাশি বিজয়ীদের স্বীকৃতি দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বহুদিন পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এই প্রক্রিয়াকে আমরা স্বাগত জানাই।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমার মতে, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সরাসরি প্রার্থী দেয়নি। তবে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট নির্বাচন করেছে এবং তারা বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছে। তাদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন।”
ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে কী হতে পারে—এ প্রসঙ্গে বিএনপির এ নেতা বলেন, “ডাকসু-চাকসু যাই হোক না কেন, এখানকার বিজয়ীদের কেউ কেউ পরবর্তীতে বড় রাজনৈতিক নেতা হয়েছেন। আবার অনেকেই এখনও সংগ্রাম করছেন। শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি মূলত জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। তবে বাস্তবতা হলো, বড় রাজনৈতিক দলের ছায়া ছাড়া ডাকসুতে বিজয়ী হওয়া নেতাদের জাতীয় রাজনীতিতে খুব একটা সফল হতে দেখা যায়নি।”
তিনি ছাত্ররাজনীতির অপরিহার্যতা তুলে ধরে বলেন, “আমাদের দেশের ইতিহাসে সামাজিক পরিবর্তন, রাজনৈতিক রূপান্তর, এমনকি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বড় পরিবর্তন এসেছে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। ছাত্র সংসদগুলো সেই পরিবর্তনেরই অন্যতম সূতিকাগার। তাই ছাত্ররাজনীতি টিকে থাকা জরুরি।”
এবারের ডাকসু নির্বাচনে মোট ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এর মধ্যে ২৩টি পদেই জয়ী হয়েছে শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট। বিশেষ করে তিনটি শীর্ষ পদ—সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)—সবকটিতেই জোটের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন।
-
ভিপি পদে শিবিরের মো. আবু সাদিক (সাদিক কায়েম) পেয়েছেন ১৪ হাজার ৪২ ভোট, যেখানে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত মো. আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন মাত্র ৫ হাজার ৭০৮ ভোট।
-
জিএস পদে এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট, তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত তানভীর বারী হামীম পেয়েছেন ৫ হাজার ২৮৩ ভোট।
-
এজিএস পদে মহিউদ্দিন খান বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়ে পেয়েছেন ১১ হাজার ৭৭২ ভোট, যেখানে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত তানভীর আল হাদী মায়েদ পেয়েছেন ৫ হাজার ৬৪ ভোট।
এছাড়াও আরও বহু সম্পাদকীয় পদ ও সদস্যপদে জোটটির প্রার্থীরা জয় লাভ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক ফাতেমা তাসনিম জুমা (১০ হাজার ৬৩১ ভোট), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ইকবাল হায়দার (৭ হাজার ৮৩৩ ভোট), ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক উম্মে সালমা (৯ হাজার ৯২০ ভোট), আন্তর্জাতিক সম্পাদক জসীমউদ্দিন খান (৯ হাজার ৭০৬ ভোট), ক্রীড়া সম্পাদক আরমান হোসেন (৭ হাজার ২৫৫ ভোট) প্রমুখ।
তবে পুরো নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট আধিপত্য বিস্তার করলেও তিনটি সম্পাদকীয় পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয় হয়েছে।
-
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ (৭ হাজার ৭৮২ ভোট),
-
গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে সানজিদা আহমেদ তন্বি (১১ হাজার ৭৭৮ ভোট),
-
সমাজসেবা সম্পাদক পদে মো. যুবাইর বিন নেছারী (এবি জুবায়ের) (৭ হাজার ৬০৮ ভোট)।
এছাড়া সদস্য পদে জয়ী হয়েছেন কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও।
গত মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আটটি কেন্দ্রে ৮১০টি বুথে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এবার মোট ভোটার ছিলেন প্রায় ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন, যার মধ্যে নারী ভোটার প্রায় ১৮ হাজার ৯৫৯ জন এবং পুরুষ ভোটার ২০ হাজার ৯১৫ জন।
ডাকসুর ২৮টি পদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রতি হলে ১৩টি করে মোট ২৩৪টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। সব মিলিয়ে ৪৭১ জন ডাকসু প্রার্থী এবং ১ হাজার ৩৫ জন হল সংসদ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অর্থাৎ একজন ভোটারকে গড়ে ৪১টি ভোট দিতে হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এত বড় পরিসরে এই নির্বাচন আয়োজন গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ইতিবাচক হলেও ছাত্রদল ও অন্যান্য প্যানেলের ভরাডুবি বিএনপির জন্য একটি বড় রাজনৈতিক বার্তা বয়ে এনেছে। অন্যদিকে শিবির সমর্থিত জোটের এই সাফল্য ভবিষ্যতের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।
সালাহউদ্দিন আহমদের মন্তব্যকে অনেকে দেখছেন বিএনপির তরফ থেকে বাস্তবতা মেনে নেওয়ার একটি ইঙ্গিত হিসেবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডাকসু নির্বাচনের ফল ছাত্ররাজনীতির শক্তির ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ