
ফাইল ছবি
কাতারের রাজধানী দোহায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের শীর্ষ নেতাদের অবস্থান লক্ষ্য করে ইসরাইল বিমান হামলা চালিয়েছে। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় রাতের দিকে টানা অন্তত ১২ দফা বিমান হামলা চালানো হয়, যা শুধু কাতার নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে। তবে ভাগ্যক্রমে প্রাণে রক্ষা পান সেখানে অবস্থানরত হামাসের শীর্ষ নেতারা। হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য খলিল আল-হাইয়া, জাহের জাবারিনসহ আরও কয়েকজন নেতাকে লক্ষ্য করেই এই হামলা চালানো হয়।
ইসরাইলি হামলায় হামাস নেতাদের অবস্থানস্থল হোটেলটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই হোটেলেই গাজায় যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার নানা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন হামাস নেতারা। আল-জাজিরা জানিয়েছে, হামাস নেতারা নিরাপদে আছেন, তবে পুরো ঘটনা কাতার সরকারের জন্য নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের এক বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে।
কাতারের তীব্র প্রতিক্রিয়া
কাতার সরকার এক বিবৃতিতে হামলাকে "কাপুরুষোচিত" আখ্যা দিয়ে বলেছে, এটি তাদের সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি বলেন, “ইসরাইল যে বেপরোয়া আচরণ করছে তা শুধু কাতারের নিরাপত্তাই নয়, গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। আমাদের সার্বভৌমত্ব লক্ষ্য করে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বরদাশত করা হবে না।”
জাতিসংঘের উদ্বেগ
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই হামলাকে কাতারের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রকাশ্য লঙ্ঘন বলেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কাতার ইতিমধ্যেই গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই অবস্থায় হামলা শান্তি প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতিকে দূরে ঠেলে দেবে।
ইরানের নিন্দা
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই এক বিবৃতিতে বলেন, “অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অপরাধমূলক এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করার পাশাপাশি কাতারের জাতীয় সার্বভৌমত্বে নগ্ন হস্তক্ষেপ। এই আগ্রাসন পুরো অঞ্চলের শান্তিকে হুমকির মুখে ফেলছে।”
ইয়েমেনের প্রতিক্রিয়া
ইয়েমেনের সুপ্রিম পলিটিক্যাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাহদি আল-মাশাত বলেন, “আজ দোহায় যা ঘটেছে, তা যদি আমরা একসঙ্গে প্রতিরোধ না করি তবে আগামীকাল একই দৃশ্য অন্য আরব দেশগুলোতেও ঘটবে। ইসরাইলি আগ্রাসন রুখতে আরবদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
সৌদি আরবের সতর্কবার্তা
সৌদি আরব এ হামলাকে ‘ভ্রাতৃপ্রতীম কাতার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। রিয়াদ জানিয়েছে, ইসরাইলি আগ্রাসন যদি অব্যাহত থাকে তবে এর গুরুতর পরিণতি বহন করতে হবে।
পাকিস্তানের সহানুভূতি
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ হামলাকে ‘অযৌক্তিক ও আগ্রাসী’ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, “কাতারের জনগণ ও নেতৃত্বের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন অবিচল থাকবে। একই সঙ্গে পাকিস্তান সবসময় ফিলিস্তিনের সংগ্রামের পাশে রয়েছে।”
ইরাকের অবস্থান
ইরাক এই হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়ে কাতারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। বাগদাদ জানিয়েছে, আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় তারা সবসময় কাতারের পাশে থাকবে।
তুরস্কের ক্ষোভ
আঙ্কারা জানিয়েছে, এই হামলা প্রমাণ করে ইসরাইল গাজার গণহত্যার সমাধানে কোনো আগ্রহ রাখে না। তুরস্ক অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা ও কূটনৈতিক আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানায়।
জর্ডানের মন্তব্য
জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেন, “এই আক্রমণ জাতিসংঘ সনদের প্রকাশ্য লঙ্ঘন। ইসরাইলের আগ্রাসন শুধু কাতার নয়, গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।”
ইউএইর প্রতিক্রিয়া
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এ হামলাকে "বিশ্বাসঘাতক ও কাপুরুষোচিত" বলে আখ্যা দেয়। দেশটি আন্তর্জাতিক আইন মেনে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানায়।
আরব লীগের বিবৃতি
আরব লীগ বলেছে, “কাতারের সার্বভৌমত্বে এই হামলা শুধু একটি রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ নয়, এটি গোটা আরব বিশ্বের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করছে।” সংস্থাটি ভবিষ্যতে এমন আগ্রাসন ঠেকাতে যৌথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।
মালদ্বীপের উদ্বেগ
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু বলেছেন, “কাতারে ইসরাইলি বিমান হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও সার্বভৌমত্বের গুরুতর লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে হবে।”
ভ্যাটিক্যানের প্রতিক্রিয়া
ভ্যাটিক্যানের পোপ লিও চতুর্দশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এই হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। তার মতে, “এটি শুধু কাতারের জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক।”
দোহায় ইসরাইলি বিমান হামলার ঘটনা শুধু কাতারের সার্বভৌমত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিক অঙ্গনকেও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে শুরু করে ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া, এমনকি ভ্যাটিক্যান পর্যন্ত সবাই এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী এখন প্রশ্ন উঠছে—ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি অব্যাহত থাকলে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ