
ছবি: সংগৃহীত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে পূর্বালী ব্যাংক মতিঝিল শাখায় থাকা একটি লকার জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকালে সেনা কল্যাণ ভবনে অবস্থিত ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়ে এই লকার জব্দ করা হয়। লকারটির নম্বর ১২৮। সিআইসির মহাপরিচালক আহসান হাবীব বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার নামে পূর্বালী ব্যাংকে একটি লকার চিহ্নিত করা হয়। লকারটির দুটি চাবির একটি শেখ হাসিনার কাছে রয়েছে। এনবিআরের গোয়েন্দা টিম আনুষ্ঠানিকভাবে এটি জব্দ করেছে। ভেতরে কী রয়েছে তা এখনো খোলা হয়নি। বিস্তারিত তথ্য আমরা পরে জানাব।”
সিআইসি সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ব্যাংক লেনদেন ও সম্পদের খোঁজে সম্প্রতি বড় ধরনের অনুসন্ধান শুরু হয়। এর অংশ হিসেবে দেশের ৬৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়। সেই চিঠিতে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নামে এফডিআর, আমানত হিসাব, লকার ও অন্যান্য আর্থিক সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছিল।
ব্যাংকগুলোর পাঠানো প্রতিবেদনে বেশ কিছু তথ্য সামনে আসে। বিশেষ করে পূর্বালী ব্যাংকে শেখ হাসিনার নামে লকার থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর বুধবার সিআইসির একটি বিশেষ টিম সেখানে অভিযান চালায়। অভিযান শেষে লকার জব্দ করে এনবিআরের হেফাজতে নেওয়া হয়।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, লকারের ভেতরে থাকতে পারে –
-
মূল্যবান দলিলপত্র
-
অলঙ্কার ও ধাতব সম্পদ
-
বিভিন্ন ফাইল ও গোপন নথি
-
এমনকি বিদেশে সম্পদ পাচারের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রমাণপত্র
এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করছেন, লকারে থাকা তথ্য দেশের বাইরে পাচার হওয়া বিপুল অর্থ ও সম্পদের উৎস খুঁজে বের করতে সহায়ক হতে পারে।
সিআইসির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা অন্তত ১১টি প্রভাবশালী শিল্পগ্রুপ বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। এই অর্থে বিদেশে সম্পদ গড়ে তোলার প্রমাণ হাতে পেয়েছে এনবিআর। পাচারের অভিযোগে যেসব গ্রুপের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে –
-
আইপিই গ্রুপ (বিদেশি ব্যবসায়ী আদনান ইমাম)
-
আরামিট গ্রুপ (সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী)
-
এস আলম গ্রুপ
-
বেক্সিমকো গ্রুপ
-
সিকদার গ্রুপ
-
নাসা গ্রুপ
-
ওরিয়ন গ্রুপ
-
জেমকন গ্রুপ
-
নাবিল গ্রুপ
-
সামিট গ্রুপ
এই শিল্পগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাংক লুট, বিদেশে অবৈধ অর্থ স্থানান্তর এবং ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পদ সঞ্চয়ের অভিযোগ রয়েছে। এনবিআর ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, এই গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদশালী হয়েছে।
কেবল প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি পর্যায়েও বড় ধরনের নাম এসেছে দুর্নীতির তালিকায়। ব্যাংক লুটপাট ও অর্থ পাচারে ৫২ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম প্রকাশ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং এনবিআর বলছে, শিগগিরই সম্পদ জব্দসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লকার জব্দের পর এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো এর ভেতরে কী রয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, আদালতের অনুমতি নিয়ে শিগগিরই লকার খোলা হবে। তখন সেখান থেকে উদ্ধারকৃত দলিলপত্র ও সম্পদ জব্দ করে তদন্তের কাজে ব্যবহার করা হবে।
অর্থ পাচার, ব্যাংক লুট ও দুর্নীতির অভিযোগে এনবিআরের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠীর ব্যাংক লকার জব্দকরণ বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ সঞ্চয়ের চিত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে। তারা বলছেন, এই ধরণের পদক্ষেপ টেকসই হতে হলে শুধু লকার বা ব্যাংক হিসাব নয়, বিদেশে রাখা সম্পদের দিকেও কঠোর নজর দিতে হবে।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি লকার থেকে প্রমাণ মেলে, তবে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করা হতে পারে। একইসঙ্গে শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মালিকদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে