
ছবি: সংগৃহীত
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনায় এসেছে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের গোপন কর্মকাণ্ড। নিরাপত্তা সংস্থা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, দলটি সরাসরি রাজনীতিতে ফেরার কোনো বৈধ পথ না থাকায় এখন গোপনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে। এর সর্বশেষ কৌশল হিসেবে চালু হয়েছে কথিত ‘অপারেশন চক্রবাল’ নামের তিন মাস মেয়াদি একটি পরিকল্পনা, যার উদ্দেশ্য হলো দেশজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলা।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের ছোট ছোট সেল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছে। এসব সেলের মূল কাজ হলো হঠাৎ করে ঝটিকা মিছিল বের করা, কয়েক মিনিটের মধ্যে পতাকা উড়িয়ে স্লোগান দিয়ে মিলিয়ে যাওয়া, বাস বা গাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো এবং হাটবাজারে অগ্নিসংযোগ করা। শুধু গত আট দিনেই ঢাকায় শতাধিক ঝটিকা মিছিল হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমপি। ভিডিও ফুটেজ দেখে অন্তত ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে সাবেক সাংসদও রয়েছেন।
গোয়েন্দারা বলছেন, এইসব কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ছোট ছোট গ্রুপ। অন্যদিকে একটি বড় অংশ ভার্চুয়াল মাধ্যমে সক্রিয়। তারা বিদেশে থাকা পলাতক নেতাদের নির্দেশে ভুয়া তথ্য, বিভ্রান্তিকর প্রচারণা এবং নাশকতার নির্দেশনা ছড়াচ্ছে।
একটি গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল দিল্লিতে অফিস খুলে বসে আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) পরিচালনা করছেন। অভিযোগ উঠেছে, এখান থেকেই এসেছে ‘অপারেশন চক্রবাল’-এর মূল পরিকল্পনা। দেশে কাজ করা কর্মীদের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হচ্ছে এবং বিদেশে পাচার করা অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে নাশকতার জন্য।
ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, সায়েন্সল্যাব ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহীতে গোপন সেল সক্রিয় রয়েছে। এই সেলগুলো প্রায়শই মোবাইল ব্যবহার না করে সরাসরি বার্তা পৌঁছায়, যাতে গোয়েন্দারা তাদের ধরতে না পারে।
ডিএমপি কমিশনার ইতোমধ্যেই কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন ঝটিকা মিছিল বন্ধে। মাঠপর্যায়ে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, “পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি দেশ অস্থিতিশীল করতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। অতীতে আমরা তাদের প্রতিটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেছি, এবারও করব। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
ডিএমপির উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “যেসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি কম, তারা সেসব জায়গা বেছে নেয়। তবে ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করে একে একে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।”
রোববার প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে— কোনোভাবেই এ ধরনের গোপন তৎপরতা সহ্য করা হবে না। বেআইনি সমাবেশ রোধে মাঠপর্যায়ে পেট্রোলিং ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসাদুজ্জামান মনে করেন, “আওয়ামী লীগের সামনে এখন বৈধ রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নেই। তাই তারা আতঙ্ক সৃষ্টি করে সরকারকে অস্থির করার চেষ্টা করছে। তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারবে না। কারণ জনগণ রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্লান্ত।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মাহবুব হোসেন বলেন, “অপারেশন চক্রবাল মূলত মনস্তাত্ত্বিক সন্ত্রাস। অল্প সময়ের জন্য ঝটিকা মিছিল বা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা সরকার ও জনগণের মধ্যে ভয় তৈরি করতে চায়। কিন্তু গোয়েন্দারা যদি নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে সক্ষম হয়, তাহলে এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।”
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অধ্যাপক শারমিন আক্তার বলেন, “দেশে পরিবর্তনের পর সবাই চায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা। যারা অপতৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে তারা শুধু নিজেদের ধ্বংসই ডেকে আনছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ আর সহানুভূতি দেখাবে না।”
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নতুন কৌশল ‘অপারেশন চক্রবাল’ দেশকে অস্থিতিশীল করার একটি সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা। তবে সরকারের কঠোর অবস্থান, নিরাপত্তা সংস্থার বাড়তি নজরদারি এবং জনগণের শান্তি প্রত্যাশাই এই পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি গোয়েন্দারা বিদেশি অর্থায়নের পথ বন্ধ করতে পারে এবং গোপন সেলগুলো শনাক্ত করতে সক্ষম হয়, তবে আওয়ামী লীগের এই ষড়যন্ত্র আর দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ