
ছবি: সংগৃহীত
নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধকরণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেনারেশন-জি (Gen Z) তরুণদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বিক্ষোভ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের ঝড় বয়ে গেছে। সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানী কাঠমান্ডু ও পূর্বাঞ্চলীয় শহর ইটাহারিতে অন্তত ১৯ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু এবং চার শতাধিকেরও বেশি আহত হওয়ার পর নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক নৈতিক কারণে পদত্যাগ করেছেন।
পদত্যাগের প্রেক্ষাপট
সোমবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির সরকারি বাসভবন বালুওয়াতারে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে রমেশ লেখক নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন। মন্ত্রিসভায় উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভয়াবহ সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা এবং সরকারের কঠোর সমালোচনার মুখে লেখক দায় স্বীকার করে দায়িত্ব ছাড়েন।
লেখককে মাত্র এক বছর আগে, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তরুণদের আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হওয়া এবং নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত পদ ছাড়তে হলো তাকে।
কীভাবে শুরু হলো বিক্ষোভ?
“জেনারেল জেড মুভমেন্ট” নামে পরিচিত এই বিক্ষোভ শুরু হয় মূলত দুর্নীতি দমন, শাসন ব্যবস্থার সংস্কার এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির দাবিতে। তরুণ-প্রজন্মের নেতৃত্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত আহ্বান দ্রুত দেশের প্রধান প্রধান শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয় যখন সরকার ফেসবুক, এক্স (পূর্বে টুইটার), ইউটিউবসহ জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সরকারের এই পদক্ষেপকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেন তরুণরা। এর পরপরই হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
সহিংসতায় রূপ নেয় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ
প্রথমদিকে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও সোমবার তা ব্যাপক সহিংসতায় রূপ নেয়। রাজধানী কাঠমান্ডুর সংসদ ভবনের ভেতরে শত শত বিক্ষোভকারী প্রবেশ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ গুলি চালায়। শুধু কাঠমান্ডুতেই অন্তত ১৭ জন নিহত হন। এছাড়া পূর্বাঞ্চলীয় শহর ইটাহারিতে আরও দুইজনের মৃত্যু হয়।
পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে আহত হন ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ, যাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহতদের বেশিরভাগই তরুণ-তরুণী। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর রাজধানীসহ বড় বড় শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বিক্ষোভের পরপরই নেপালি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে সাধারণ সম্পাদক গগন থাপা ও বিশ্ব প্রকাশ শর্মা লেখকের পদত্যাগ দাবি করেন। তারা মনে করেন, নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করাই বর্তমান পরিস্থিতিতে একমাত্র উপযুক্ত পদক্ষেপ। যদিও কংগ্রেস সভাপতি শের বাহাদুর দেউবা শুরুতে এ বিষয়ে নীরব ছিলেন, পরে লেখক নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে পদত্যাগ করেন।
অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলো সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বলেছে, জনগণের ন্যায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করে দমননীতির আশ্রয় নিতেই আজকের এই রক্তপাত ঘটেছে। তরুণ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে সরকার গণতন্ত্রের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
জেন-জি আন্দোলনের তাৎপর্য
নেপালে জেনারেশন-জি নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলনকে দেশটির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আন্দোলনের শুরুতে মূল দাবিগুলো ছিল দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সরকারের নিষেধাজ্ঞা ও সহিংস দমননীতি এ আন্দোলনকে আরও বিস্তৃত ও তীব্র করেছে।
বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী অনেক তরুণ জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবল বিনোদনের জন্য নয়; এটি এখন মতপ্রকাশের একটি বড় প্ল্যাটফর্ম। সরকার যখন সেটিকে বন্ধ করার চেষ্টা করেছে, তখন তারা এটিকে গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এ ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘও সহিংসতার ঘটনা তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ
রমেশ লেখকের পদত্যাগে সরকারের প্রতি চাপ কিছুটা প্রশমিত হলেও পুরোপুরি সংকট কেটে যায়নি। সরকারের সামনে এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো তরুণদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া এবং একটি স্থায়ী সমাধানের পথ বের করা। অন্যথায় আন্দোলন আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
নেপালের এই ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তরুণ-প্রজন্ম এখন শুধু দর্শক নয়, বরং সক্রিয়ভাবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আসছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা এবং দুর্নীতিবিরোধী দাবিকে উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ নিঃসন্দেহে বড় ঘটনা, তবে এটি সমস্যার সমাধান নয়—বরং বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কারের দিকে একটি সতর্কবার্তা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ