
ছবি: সংগৃহীত
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে নেপালজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তরুণদের বিক্ষোভ। রাজধানী কাঠমান্ডুতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সরকার সেনা মোতায়েন করে এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন কারফিউ জারির ঘোষণা দেয়। ইতোমধ্যে একজন নিহত হয়েছেন এবং অন্তত ৮০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ
৪ সেপ্টেম্বর থেকে নেপাল সরকার ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ ২৬টি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের ব্যাখ্যা— এসব প্ল্যাটফর্ম দেশে গুজব, ঘৃণামূলক বক্তব্য, সাইবার অপরাধ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়াচ্ছে। নেপালের ৩ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হওয়ায় সিদ্ধান্তটি জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভুয়া আইডি ব্যবহারকারীদের কার্যক্রমের কারণে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। তাই অনিবন্ধিত কোনো প্ল্যাটফর্মকে চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে না। সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিবন্ধনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু তারা সেই শর্ত পূরণ না করায় পরদিন থেকেই সবগুলো প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে সহিংসতায় রূপ
সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে হাজারো তরুণ কাঠমান্ডুতে জড়ো হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল শুরু করেন। তারা সরকারের সিদ্ধান্তকে “মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত” আখ্যা দেন। আন্দোলনকারীরা এই বিক্ষোভকে “জেন-জি রেভলিউশন” নামে ডাকতে শুরু করেন।
এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে পার্লামেন্টের সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে এবং পরে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন তরুণ গুরুতর আহত হন। পরে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অন্তত ৮০ জনকে ভর্তি করা হয়।
কারফিউ ও সেনা মোতায়েন
পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির কারণে কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন আইনের ৬ ধারায় কারফিউ জারির ঘোষণা দেয়। স্থানীয় প্রশাসক ছাবিলাল রিজাল জানান, দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা কারফিউর আওতায় থাকবে। এর মধ্যে প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন, ভাইস-প্রেসিডেন্টের বাসভবন, পার্লামেন্ট ভবন, মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন উচ্চ নিরাপত্তা এলাকা রয়েছে।
প্রশাসনের নির্দেশ অনুযায়ী সেনা মোতায়েন করা হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কারফিউ চলাকালে সাধারণ নাগরিকদের ঘরের বাইরে না থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরকার বনাম আন্দোলনকারীদের অবস্থান
নেপাল সরকার বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা ছাড়া বিকল্প নেই। সরকারের দাবি, “ভুয়া অ্যাকাউন্ট, ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং গুজব ছড়িয়ে দেশে সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে।”
অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা মনে করছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ মূলত জনগণের কণ্ঠরোধ করার এক ধরনের কৌশল। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, সরকার তরুণদের আওয়াজ দমন করতে ইচ্ছাকৃতভাবে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। তারা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত দেশে এক নতুন ধরণের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট জানিয়েছে, আন্দোলন এখন শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ও তরুণ চাকরিপ্রার্থীরা সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করছেন।
আন্তর্জাতিক মহলও বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নেপালের মতো একটি দেশে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে দুর্বল, সেখানে তরুণদের কণ্ঠরোধ করলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে।
আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ
সরকার একদিকে সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখার কথা বললেও, অপরদিকে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করার কারণে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ছে। এখন বড় প্রশ্ন হলো— কারফিউ শেষ হওয়ার পর আন্দোলন থেমে যাবে নাকি আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে। তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলন নেপালের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করবে কি না, তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ