
ছবি: সংগৃহীত
কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরাইলের বিমান হামলার ঘটনাকে ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চরম ক্ষোভ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ (UNSC) বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) এক জরুরি বৈঠকে বসে এবং সর্বসম্মতভাবে এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পরিষদের সব ১৫ সদস্য রাষ্ট্রই ওই বিবৃতিতে কাতারের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এবং পরিস্থিতি দ্রুত প্রশমনের আহ্বান জানায়। তবে সমালোচনার বিষয় হলো, এই বিবৃতিতে কোথাও ইসরাইলের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
নজিরবিহীন হামলা ও হতাহত
গত মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) দোহায় ইসরাইলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল হামাসের একটি অফিস ভবন। গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে বৈঠক চলাকালীন সময়েই এই হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় নিহত হন ছয়জন, যার মধ্যে রয়েছেন হামাসের সিনিয়র নেতা খলিল আল-হাইয়ার ছেলে হুমাম, তার তিনজন দেহরক্ষী, আরও একজন হামাস সদস্য এবং এক কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা।
হামলার উদ্দেশ্য ছিল হামাসের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বকে নির্মূল করা। যদিও ফিলিস্তিনি সংগঠনটি দাবি করেছে, তাদের শীর্ষ নেতারা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। তবুও এ ঘটনায় দোহা এবং গোটা উপসাগরীয় অঞ্চলে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি ও সীমাবদ্ধতা
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এই যৌথ বিবৃতির খসড়া প্রস্তুত করেছিল ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য। বিবৃতিতে বলা হয়, “কাতারের প্রতি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা গভীর সংহতি প্রকাশ করছে। বর্তমান পরিস্থিতি প্রশমন অত্যন্ত জরুরি।” আরও জোর দেওয়া হয় গাজায় যুদ্ধ ও মানবিক সংকট দ্রুত বন্ধ করার ওপর। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে, যাদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন।
তবে বিবৃতিতে ইসরাইলের নাম সরাসরি উল্লেখ না করায় ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও এর পশ্চিমা মিত্রদের চাপেই ইসরাইলকে দায়ী করা হয়নি।
কাতারের কঠোর প্রতিক্রিয়া
ইসরাইলি হামলার ঘটনায় কাতারের শীর্ষ নেতৃত্ব তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জমিস আল-থানি বুধবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ইসরাইলি আগ্রাসনের জবাব অবশ্যই দেওয়া হবে এবং সেই জবাব আসবে সমন্বিতভাবে পুরো আরব বিশ্বের পক্ষ থেকে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এটি কেবল কাতারের বিরুদ্ধে নয়, বরং সমগ্র আরব অঞ্চলের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা। আমাদের প্রতিক্রিয়া এখন আরব বিশ্বের অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হচ্ছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই হামলাকে “একতরফা ও অযৌক্তিক” বলে অভিহিত করেছে। তবে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকেও ইসরাইলের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এতে অনেকেই মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র একদিকে শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে চাইছে, অন্যদিকে ইসরাইলকে সরাসরি দায়ী করে বিরোধিতা বাড়াতে চাইছে না।
এদিকে আরব দেশগুলো ও মুসলিম বিশ্বের নানা সংগঠন ইসরাইলের এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তুরস্ক, ইরান, কুয়েত, আলজেরিয়া, পাকিস্তানসহ বহু দেশ এটিকে আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে।
আসন্ন আরব-ইসলামি সম্মেলন
হামলার প্রতিক্রিয়ায় কাতার একটি জরুরি আরব-ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনের ডাক দিয়েছে। আগামী রোববার ও সোমবার দোহায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে উপসাগরীয় ও বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের নেতারা একত্রিত হয়ে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সম্মেলন থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে।
আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা
বিশ্লেষকরা বলছেন, দোহায় এই হামলা শুধু কাতারকেই নয়, গোটা অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। একদিকে হামাসের নেতৃত্বকে লক্ষ্যবস্তু করে ইসরাইল নতুন বার্তা দিতে চাইছে, অন্যদিকে আরব দেশগুলো একত্রিত হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন কূটনৈতিক ফ্রন্ট গড়তে পারে।
সব মিলিয়ে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দা সত্ত্বেও ইসরাইলের নাম উল্লেখ না করা ভবিষ্যতে এই সংকট সমাধানে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পর্যবেক্ষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ