
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ দৈনিক ফিনান্সিয়াল টাইমস। পত্রিকাটির ‘বাংলাদেশ’স মিসিং বিলিয়নস: স্টোলেন ইন প্লেইন সাইট’ শিরোনামের নতুন ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে চলে গেছে।
ডকুমেন্টারিতে আন্দোলনকারী, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন— কীভাবে এত বিপুল অর্থ বিদেশে চলে গেল এবং আদৌ তা ফেরত আনা সম্ভব হবে কি না। বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়েছে, এই বিপুল অর্থ পাচারের ঘটনায় সরকারি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যর্থ ছিল।
ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি শেখ হাসিনা সরকার বিতর্কিত কোটা সংস্কার প্রস্তাব আনে। ছাত্রসমাজ ও তরুণরা এটিকে রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়স্বজনের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানের চেষ্টা হিসেবে দেখেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব।
প্রথম দিকে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ না হলেও ১৪ জুলাই থেকে সরকারি বাহিনী দমন-পীড়ন শুরু করে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, পুলিশের গুলি, স্নাইপার, এমনকি হেলিকপ্টার থেকে শেল নিক্ষেপের মতো শক্তিশালী ব্যবস্থা ব্যবহৃত হয়।
পরিস্থিতি ৫ আগস্টে মোড় নেয়। নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো থেকে সরে আসে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। জাতিসংঘের হিসাবে, এই আন্দোলনে অন্তত ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। হাজারো মানুষ আহত বা নিখোঁজ হন।
দীর্ঘদিন ধরেই শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ মহলের বিরুদ্ধে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে যুক্তরাজ্য এই পাচারের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। লন্ডনের শক্তিশালী আর্থিক ও রিয়েল এস্টেট খাত ব্যবহার করে বিপুল অর্থ বিদেশে স্থানান্তরিত হয়।
ডকুমেন্টারিতে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার পরিবার এবং রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক—যিনি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী—কেও এই পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠে। বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ ও হুন্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদেশে প্রেরণ করা হয়েছিল।
ফিনান্সিয়াল টাইমস জানায়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি সম্পত্তি রয়েছে। ব্রিটিশ অপরাধ দমন সংস্থা ইতিমধ্যে প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তি জব্দ করেছে।
ডকুমেন্টারিতে অভিযোগ এসেছে যে, হাসিনা সরকারের সময় সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় সাবেক শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠরা ব্যাংক দখল করে। অনেক ব্যাংকের পরিচালককে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এরপর ওই ব্যাংকগুলো থেকে হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণ দেওয়া হয় নিজেদের স্বার্থে, যার বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয় হুন্ডি মাধ্যমে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক লুটপাট। অনুমান করা হচ্ছে, ব্যাংক ও ব্যবসা খাত থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার।
শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষমতার শূন্যতা পূরণে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। তিনি সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা আহসান মনসুরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, অন্তত ১১টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে, এবং ব্যাংক খাত সচল রাখতে সরকার ইতিমধ্যে ২৯ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে বছরের পর বছর সময় লাগবে।
ডকুমেন্টারিতে আরও বলা হয়েছে, দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত গড়ায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচনের চাপ বাড়ছে। ড. ইউনূস জানিয়েছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার না করলে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভাব্য নির্বাচন হতে পারে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণের প্রত্যাশা এখন আকাশচুম্বী। তবে মৌলিক সংস্কার না ঘটালে বাংলাদেশ আবারও ক্ষমতার একচেটিয়া দখল ও দুর্নীতির ফাঁদে পড়ে যেতে পারে।
ফিনান্সিয়াল টাইমসের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্নীতির চিত্র চ্যালেঞ্জিংভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং দেশবাসীর মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়ে গেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ