
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের পরিবহন খাতে আধুনিকায়নের প্রতীক হিসেবে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল গাজীপুর-উত্তরা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পকে। কিন্তু সময় গড়িয়েছে, খরচ বেড়েছে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি, মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে পাঁচবার, অথচ শেষ হয়নি কাজ। বরং, প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা আর অব্যবস্থাপনার কারণে এ সড়ক এখন পরিণত হয়েছে অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে। রাত হলেই যেন এই সড়ক মাদকসেবী, ছিনতাইকারী ও খুনিদের দখলে চলে যায়। ফলে একসময় নাগরিকদের স্বস্তির আশা দেখানো বিআরটি আজ আতঙ্কের আরেক নাম।
গাজীপুর থেকে উত্তরা পর্যন্ত বিআরটি করিডোরে দিন-রাতই এখন ভয়ের ছায়া। চলন্ত গাড়িতে বসে ফোনে কথা বললেও নিরাপত্তা নেই। ছিনতাইকারীরা মুহূর্তেই জানালা ভেঙে বা দরজা খুলে মোবাইল-ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। কেউ নির্জন জায়গায় গাড়ি থেকে নামলেই অস্ত্রের মুখে সর্বস্ব লুট করা হয়। শুধু তাই নয়, বাধা দিলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
এলাকাবাসী জানাচ্ছেন, সড়কের দুই পাশের বস্তিগুলো মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের গোপন আস্তানায় রূপ নিয়েছে। সূর্য ডোবার পর থেকেই তাদের আনাগোনা শুরু হয়। মাদকের টাকা জোগাড় করতে প্রতিদিনই ঘটে ছিনতাই, চুরি কিংবা খুন। আলোহীন ও ফাঁকা স্টেশনগুলো যেন আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে আরও কয়েকগুণ।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপ-কমিশনার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা বারবার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত আলো, সিসিটিভি ও টহল নিশ্চিত করতে হবে। কিছু এলাকায় সিসিটিভি বসানো হয়েছে, আরও কিছু জায়গায় বসানোর কাজ চলছে। এগুলো চালু হলে অপরাধীদের শনাক্ত করা সহজ হবে। কিন্তু প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।”
জিএমপি সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে বিআরটি করিডোরকে ঘিরে হাজারের বেশি অপরাধীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই পুরনো ছিনতাইকারী চক্র, আবার কেউ মাদক ব্যবসায়ী।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরও এখনো প্রকল্প শেষ হয়নি, অথচ জনগণ প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার। সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের ওপরও নাগরিকদের চাপ আসে, কিন্তু প্রকল্পটি যেহেতু জাতীয় পর্যায়ের, তাই স্থানীয় সরকার এক্ষেত্রে খুব একটা হস্তক্ষেপ করতে পারছে না। এভাবে টাকা খরচ করে জনগণকে দুর্ভোগে ফেলা অনৈতিক।”
বিআরটি প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, “নিরাপত্তা জোরদারের জন্য পুরো প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আধুনিক সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হবে। এখন যেটুকু বসানো হয়েছে, তা পরীক্ষামূলকভাবে। কাজ শেষ হলে করিডোর পুরোপুরি নিরাপদ হবে।”
তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, জনগণ এখনই নিরাপত্তা চায়, প্রকল্প শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে পারছে না।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (ডুয়েট) নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, “এখন আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নেই। ইতিমধ্যে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে, তা আর ফেরত আসবে না। তাই অপচয় না করে প্রকল্পের যতটুকু অংশ কার্যকর করা সম্ভব, সেটির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শহিদুল ইসলাম মনে করেন, “বিআরটি করিডোর এখন অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাত নয়, দিনে-দুপুরেও এখানে ছিনতাই হচ্ছে। এ ধরনের প্রকল্প কেবল অবকাঠামো নয়, মানুষের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কার্যকর করতে হবে।”
রাজউকের সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, “জনগণের টাকায় করা এমন প্রকল্প জনজীবনকে নিরাপদ না করে যদি ভয়াবহ করে তোলে, তবে এর দায় নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। এখন নতুন করে পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও জনগণের মতামতকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয়ের পর এখন কর্তৃপক্ষ বিআরটি প্রকল্পের যৌক্তিকতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি পুরোপুরি পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়। তবে পুনর্বিবেচনা করে বাস্তবসম্মত সমাধান বের করা জরুরি।
স্বপ্নের বিআরটি আজ গাজীপুরবাসীর জন্য দুঃস্বপ্ন। অবকাঠামো উন্নয়নের নামে ব্যয় করা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা, অথচ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। অপরাধ দমনে এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নিলে এ করিডোর কেবল অপরাধের ‘হটস্পট’ হিসেবেই থেকে যাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ