
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। একদিকে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা ও বিনিয়োগ বাড়ানোর চাপ, অন্যদিকে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন এক প্রতিবেদনে বলেছে, মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হলে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এগুলো হলো— ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, সামষ্টিক অর্থনীতির সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার যদি ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে থাকে, তবে তা ভোক্তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু বর্তমানে এ হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। অর্থাৎ সহনীয় মাত্রার তুলনায় অতিরিক্ত ৪ দশমিক ২৯ থেকে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি। তাই নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, অন্তত ৪ শতাংশের বেশি কমানো না গেলে এই চাপ সাধারণ মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে থাকবে।
প্রতিবেদনটি মনে করিয়ে দিয়েছে, ২০২২ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার এক লাফে ৯ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে চলে যায়। এর পর কয়েক মাস তা বেড়ে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে পৌঁছায় সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। সরকারি নানা পদক্ষেপের কারণে কিছুটা কমলেও গত এক বছরের বেশির ভাগ সময়ই ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। বর্তমানে তা কমে ৮ শতাংশের ঘরে এলেও এখনও ভোক্তার সহনীয় মাত্রার দ্বিগুণ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শুধু ক্রয়ক্ষমতাই কমে যায়নি, বরং দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগে আগ্রহও কমছে। ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে পড়ছে।
ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে বাজারে পণ্যের দামে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে পারলে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। এতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বা যন্ত্রপাতি আমদানির সময় বিনিময় হারে অতিরিক্ত চাপ পড়বে না।
প্রতিবেদন বলছে, সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে হুন্ডি ও টাকা পাচারের প্রবণতা কমেছে। এতে ডলারের জোগান কিছুটা বেড়ে বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়েছে। তবে এই ধারা টিকিয়ে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, অর্থনীতির সার্বিক স্থিতিশীলতা না থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বয় জরুরি। বর্তমান লক্ষ্য হলো ২০২৫ সালের জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতিকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা ৫ শতাংশের নিচে নামানো গেলে মুদ্রানীতি শিথিল করার সুযোগ আসবে। তখন বাজারে ঋণের সুদের হারও কমবে, বিনিয়োগ বাড়বে এবং কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
প্রতিবেদনটি স্পষ্ট করেছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক পদক্ষেপ সফল হবে না। দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধায় ভোগেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও বড় কোনো বিনিয়োগে এগোতে চান না। এর ফলে অর্থনীতির ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়, যা মুদ্রাস্ফীতি কমানোর প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, নিম্ন ও স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতি কেবল স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করবে না, বরং ভোক্তাদের মধ্যে আস্থাও তৈরি করবে যে নীতিনির্ধারকরা বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।
প্রতিবেদনটি সতর্ক করে দিয়েছে, যদি বিনিময় হার অস্থির হয় বা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে কোনো খাতেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না। অন্যদিকে, যদি তিনটি চ্যালেঞ্জই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তবে বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনতে পারবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ