
ছবি: সংগৃহীত
আজ শনিবার বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ পালন করছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)—যে দিনটি মানবজাতির জন্য এক অবিস্মরণীয়, পবিত্র ও ঐতিহাসিক দিন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরবের মক্কা নগরীতে মা আমিনার কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন মানবতার মুক্তির দূত, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। একই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে সংঘটিত হওয়ায় মুসলমানদের কাছে দিনটি একইসঙ্গে স্মরণ, শ্রদ্ধা ও প্রার্থনার দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশারি
মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণের আগে গোটা আরব ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। সমাজজীবনে ছিল অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও রক্তপাত। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল মূর্তিপূজা ও কুসংস্কার। মানুষ এক আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নানা পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিল। সেই যুগ ইতিহাসে পরিচিত ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞতার যুগ নামে। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে আলোর পথে ফেরাতে, ন্যায়-নীতি ও মানবতার শিক্ষা দিতে আল্লাহতায়ালা প্রেরণ করেন তার প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে। তিনি মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানান এবং অল্প সময়েই গোটা আরবকে অজ্ঞতার আঁধার থেকে মুক্ত করে আলোকিত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
নবুওয়ত লাভ ও ইসলামের প্রসার
অত্যন্ত অল্প বয়স থেকেই তিনি আল্লাহর প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়েন এবং প্রায়ই হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। ২৫ বছর বয়সে বাণিজ্যে সৎ ও বিশ্বস্ততার জন্য খ্যাত মহানবী (সা.) বিবি খাদিজার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর ৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় আল্লাহর নিকট থেকে নবুওয়ত লাভ করেন। সেখান থেকেই শুরু হয় ইসলামের দাওয়াত ও মানবকল্যাণের নতুন ইতিহাস।
রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি ও ধর্মীয় আয়োজন
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন পক্ষকালব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, মহানবী (সা.)-এর জীবন ও আদর্শ নিয়ে আলোচনা সভা, কোরআনখানি, সেমিনার এবং বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় বিশেষ ওয়াজ মাহফিল। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে পালিত হচ্ছে দিনটি।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বাণী
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন। তারা মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে সমাজে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ঐক্য আরও সুসংহত হোক। মহানবী (সা.)-এর আদর্শের আলোয় আমাদের জীবন হোক শান্তি, সমৃদ্ধি ও মুক্তির।’’
রাজনৈতিক নেতাদের বার্তা
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও পৃথক বাণী দিয়েছেন। তারেক রহমান বলেন, ‘‘মহানবী (সা.) সমাজে অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত ও দুঃখী মানুষের সেবায় ছিলেন নিবেদিত। তার শিক্ষা আমাদের শিখিয়েছে পরমতসহিষ্ণুতা, দয়া, ক্ষমাশীলতা, নারী জাতির মর্যাদা ও শিশুদের প্রতি দায়িত্ববোধ। তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব।”
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ ছাড়া মানবজাতির কল্যাণ সম্ভব নয়। তাকে খণ্ডিতভাবে মানলে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে না, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া জান্নাত লাভ অসম্ভব।”
মুসলিম বিশ্বের প্রতিচ্ছবি
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ দিনটি পালন করছে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। মক্কা-মদিনা, ইরান, পাকিস্তান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে জশনে জুলুস, মাহফিল, কোরআনখানি ও সীরাতুন্নবী (সা.) সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। মুসলমানরা এ দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সীরাত অধ্যয়ন, নামাজ-কালাম ও ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকেন।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীর শিক্ষা
ধর্মীয় আলেম-ওলামারা বলছেন, ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রকৃত তাৎপর্য হলো মহানবী (সা.)-এর জীবনকে অনুসরণ করা। তিনি শুধু ধর্মীয় নেতা নন, বরং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক, শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক ও মানবতার মুক্তিদাতা। তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মুসলিম উম্মাহর জন্য গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত দিন। নবীজির শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসৃত হলে বিশ্বে শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা পাবে। আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা, মহানবী (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা প্রদর্শনের মধ্য দিয়েই দিনটির প্রকৃত মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব।
বাংলাবার্তা/এমএইচ