ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহিরাঙ্গন এলাকায় বিশেষ অভিযানে নিয়োগ পরীক্ষা ও ভর্তি পরীক্ষায় সংঘবদ্ধ জালিয়াতির জন্য ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিক স্পাই ডিভাইসসহ দুই ব্যক্তিকে আটক করেছে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। আটক ব্যক্তিরা হলেন—শাহারুন আলী (৩৮) এবং মোঃ ইকবাল হোসেন জীবন (৩৫)।
এপিবিএন জানায়, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা ও ভর্তি পরীক্ষায় প্রযুক্তিনির্ভর জালিয়াতির বড় ধরনের চক্র বহুদিন ধরেই সক্রিয় রয়েছে—এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ১২ ডিসেম্বর, শুক্রবার দুপুরে বিমানবন্দরের বহিরাঙ্গন এলাকায় নজরদারি জোরদার করা হয়। সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তিকে শনাক্ত করার পর তাদের ওপর তল্লাশি চালানো হয় এবং পরে এপিবিএন কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অভিযানে মোট ৭৬ পিস ডিজিটাল ইলেকট্রনিক স্পাই ডিভাইস, ৫০টি অদৃশ্য ইয়ারপিস, ৩টি ল্যাপটপ, এবং ৬টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়—যা পরীক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারণার কাজে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল বলে এপিবিএন নিশ্চিত করেছে।
জিজ্ঞাসাবাদে ধরা পড়ে এই চক্রের ভয়ংকর কার্যপ্রণালী। গ্রেফতারকৃত শাহারুন আলী স্বীকার করেন, তিনি সাধারণ যাত্রীর বেশে নিয়মিত চীন থেকে এসব ডিভাইস দেশে নিয়ে আসতেন। পরে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষমাণ সহযোগীদের হাতে এসব সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া হতো। অভিযানের দিনও তিনি একইভাবে চীন থেকে নিয়ে আসা এসব নিষিদ্ধ ডিভাইস ইকবাল হোসেন জীবনের কাছে হস্তান্তরের চেষ্টা করছিলেন।
এ ধরনের স্পাই ডিভাইসগুলো দেখতে অনেকটাই ক্রেডিট কার্ডের মতো হওয়ায় বিমানবন্দরের সাধারণ স্ক্যানারে সহজে ধরা পড়ে না। এগুলোর ভেতরে বিশেষ ধরনের মাইক্রো-চিপ, সংযোগ সার্কিট ও বিল্ট-ইন মাইক্রো মাইক্রোফোন থাকে, যা পরীক্ষার হলে অত্যন্ত গোপনে ব্যবহার করা যায়। ডিভাইসটি সাধারণ সিমের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং শরীরের গোপন জায়গায় রেখে দিলে কোনো ইনকামিং কল স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিসিভ করে নেয়। ফলে পরীক্ষার্থীর কানে থাকা অতি ক্ষুদ্র অদৃশ্য ইয়ারপিসে বাইরের ‘অপারেটররা’ প্রশ্নের উত্তর বলে দিতে পারে।
সূত্র জানায়, এই ইয়ারপিসগুলো এতটাই ছোট যে কানে প্রবেশ করানোর পর বাইরে থেকে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা শেষে স্বচ্ছ এক্সট্রাকশন থ্রেড ব্যবহার করে সহজেই ইয়ারপিসটি বের করে নেয়—এবং কোনো প্রকার চিহ্নও থাকে না। এ কারণে জালিয়াতির এই প্রযুক্তি দীর্ঘদিন ধরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, এটি শুধু দুই ব্যক্তির অপরাধ নয় বরং দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত একটি সংঘবদ্ধ প্রযুক্তিগত জালিয়াতচক্র। এই চক্র নিয়মিত নিয়োগ পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা, এমনকি কিছু সরকারি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও বিভিন্ন সময় সক্রিয় থেকেছে। ডিভাইসগুলো দেশে পৌঁছানোর পর সেগুলো নির্দিষ্ট দামে পরীক্ষার্থীদের কাছে ভাড়া দেওয়া হতো। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্নপত্র সমাধানের জন্য ‘অপারেটর টিম’ তৈরি করা হতো, যাদের দায়িত্ব ছিল পরীক্ষার্থীর কানে এসব ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর বলে দেওয়া।
এপিবিএন সূত্র জানায়, আটক দুইজনের জিজ্ঞাসাবাদে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে, যা কাজে লাগিয়ে চক্রের মূল হোতাদের খুঁজে বের করতে তৎপরতা চলছে।
ঘটনার পরদিনই ঢাকা মহানগর পুলিশের বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর ২৫বি(১)(বি)/২৫-ডি ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। আইনের এই ধারা অনুযায়ী, আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য দেশে আনানো, তা দিয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা যায়। এই ধারায় দোষী সাব্যস্ত হলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এয়ারপোর্ট (১৩) আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অপারেশনাল কমান্ডার পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হক বলেন— “ডিভাইসগুলো আমদানি নিষিদ্ধ। বিভিন্ন নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায় এগুলো ব্যবহার করে বহু জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে—এমন প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। যেকোনো ধরনের অসাধু কার্যক্রম রোধে আমরা নিয়মিতভাবে নজরদারি ও অভিযান চালাচ্ছি। বিমানবন্দর নিরাপত্তা কঠোর করার পাশাপাশি এসব আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি-ভিত্তিক জালিয়াতি চক্রকে চিরতরে নির্মূল করাই আমাদের লক্ষ্য।”
তিনি আরও বলেন, দেশের নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষার স্বচ্ছতা রক্ষায় এমন প্রযুক্তিভিত্তিক জালিয়াতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রাখা হবে এবং এ ধরনের সব চেষ্টা ভবিষ্যতেও কঠোরভাবে দমন করা হবে।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে প্রযুক্তিনির্ভর জালিয়াতির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি জোরদার করেছে। বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্ক্যানিং ও ইন্টেলিজেন্স অপারেশন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এপিবিএন-এর এই অভিযানের মাধ্যমে আরেকটি বড় চক্রের নেটওয়ার্ক শনাক্তের অগ্রগতি হলো, যা ভবিষ্যতের নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষার নিরাপত্তায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
এপিবিএন জানায়, আটককৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরও কয়েকটি স্থানে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি চলছে। তদন্ত অগ্রসর হলে চক্রের মূল আয়োজক, প্রযুক্তি সরবরাহকারী এবং দেশের বিভিন্ন জেলা–উপজেলায় থাকা দালালদেরও চিহ্নিত করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



