ছবি: সংগৃহীত
গত অর্থবছরে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা এবং কম দামে বিক্রির কারণে সরকার ৫৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান করেছে। এ সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। বাকি ১৭ হাজার কোটি টাকার লোকসানের বোঝা এখন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ঘাড়ে। এর আগের বছরও বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল। বুধবার পিডিবির বোর্ড সভায় বিদ্যুৎ খাতের আয়-ব্যয়ের হিসাব অনুমোদন করা হয়, যেখানে বড় ধরনের লোকসানের চিত্র উঠে আসে। তবে এ বিষয়ে আপাতত কিছু বলতে নারাজ পিডিবির অর্থ সদস্য অঞ্জনা খান মজলিস। তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, বোর্ডে অনুমোদন হলেও তা প্রকাশ করার পরিস্থিতি এখন হয়নি। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে হিসাব প্রকাশ করা হবে।
মূলত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর (আইপিপি) ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়াতেই সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব চুক্তি পর্যালোচনা করতে গঠিত জাতীয় কমিটি গত মাসে একটি প্রাথমিক রিপোর্টে জানিয়েছে, বিগত সরকার আমলে গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ খাতে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। পিডিবি জানিয়েছে, গত অর্থবছরে বিদ্যুতের দাম বাড়েনি, তবে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যয় আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গ্যাসের সরবরাহ কমায় ফার্নেস অয়েল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ বেশি কিনতে হয়েছে পিডিবিকে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ১০ টাকা ৮০ পয়সা। বিতরণ কোম্পানির কাছে সরবরাহ ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিট ১২ টাকা ৫০ পয়সা, অথচ প্রতি ইউনিটের বিক্রিমূল্য মাত্র ৬ টাকা ৯৯ পয়সা। এই বিশাল ফারাকের কারণে পিডিবির লোকসান হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ভর্তুকি রয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা।
বলা বাহুল্য, পিডিবি সরকারের একক সংস্থা হিসাবে সরকারি-বেসরকারি এবং আমদানি করা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি অনুযায়ী এ খাতে সব দিক দিয়ে লাভবান হচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বা আইপিপিগুলো। কারণ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আইপিপি বা রেন্টালে উৎপাদিত বেশি দামের বিদ্যুতের লোকসানের সব টাকা ভর্তুকি হিসাবে দেয় সরকারের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়। এবার সে হিসাবে দেওয়া হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। তবে পিডিবির নিজস্ব বা সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য বেশি হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয় না।
পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট ৭ টাকা, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে ১৩ টাকা, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রে ২২ টাকা এবং ভারত থেকে (আদানি নয়) আমদানি করা বিদ্যুতের দাম পড়ে ৮ টাকার মতো। আর ডিজেলের কেন্দ্রে খরচ পড়ে ৪০ টাকার বেশি। যদিও বেসরকারি কোনো ডিজেল কেন্দ্র আর চালু নেই। শুধু আপৎকালীন সময়ের জন্য পিডিবির কয়েকটি ডিজেল জেনারেটর আছে। দেশে ১৩৫ কেন্দ্রে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আছে। এর মধ্যে আইপিপি হচ্ছে ৭০টি। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। বাকিগুলো সরকারি কেন্দ্র। তবে পুরো বিতরণ ব্যবস্থায় এখন নির্ভরযোগ্য হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৮টি কেন্দ্রে উৎপাদন ক্ষমতা ৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট।
পিডিবি জানিয়েছে, আগের বছরের তুলনায় বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। গত অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪৮.৫২ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে, ফার্নেস অয়েলে ১১.৮৩ শতাংশ, ডিজেলে ০.৪৬ শতাংশ, বায়ু বিদ্যুৎ ০.০৭ শতাংশ, সোলার থেকে ৯ শতাংশ এবং জলবিদ্যুৎ ০.৮৬ শতাংশ হয়েছে। এছাড়া ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে এখনো অরাজক অবস্থা বিরাজ করছে এবং সরকার এই খাতকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারেনি। এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব চুক্তি পর্যালোচনা করতে গঠিত জাতীয় কমিটির সদস্যরা গত মাসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক, আমলা ও রাজনীতিবিদদের যোগসাজশে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এ কারণে গ্রাহককে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ বেশি দাম দিতে হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



