
ছবি: সংগৃহীত
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে ভয়াবহ দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগে আবারও আলোচনায় এলো রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট। সরকারি নির্ধারিত খরচ জনপ্রতি প্রায় ৭৯ হাজার টাকা হলেও বাস্তবে চাকরির সুযোগ পাওয়ার আশায় প্রবাসে যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে গড়ে ৪.৫ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এই প্রক্রিয়ায় ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অন্তত ১৩টি এজেন্সি প্রায় ১২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অনুসন্ধানে প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের মহাপরিচালক (অভিযোগ ও অনুসন্ধান) মো. আক্তার হোসেন বলেন, অভিযুক্তরা বায়রা (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি)-এর সিন্ডিকেটের অংশ হয়ে রেজিস্ট্রেশনের শর্ত ভঙ্গ করেছেন। সরকার যেখানে নির্ধারিত খরচ রেখেছিল ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা, সেখানে পাঁচগুণ বেশি অর্থ আদায় করা হয় শ্রমিকদের কাছ থেকে। শুধু অতিরিক্ত অর্থ আদায় নয়, এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে অবৈধভাবে সংগৃহীত অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর, রূপান্তর ও বিদেশে পাচারেরও। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাধারণ শ্রমিকরা, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
দুদক জানিয়েছে, আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০(বি), ১৬১, ১৬২, ১৬৩, ১৬৪, ১৬৫(ক), ৪২০ ও ৪০৯ ধারাসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় মামলা দায়েরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব ধারায় দোষী সাব্যস্ত হলে কঠোর শাস্তি ও আর্থিক জরিমানা অনিবার্য।
দুদকের অনুসন্ধানে রাজধানীর ফকিরাপুলে অবস্থিত আকাশ ভ্রমণ লিমিটেড নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে একাই ১৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এজেন্সিটি দীর্ঘদিন ধরে বিদেশগামী শ্রমিকদের কাছ থেকে অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে আসছিল। শুধু তাই নয়, তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছিল না। এজেন্সির মালিকপক্ষ বিদেশে চাকরির সুযোগের নামে বহু সাধারণ পরিবারকে সর্বস্বান্ত করেছে।
এমন আরও একাধিক এজেন্সির বিরুদ্ধে একই ধরনের প্রতারণার তথ্য পেয়েছে দুদক। প্রমাণ মিলেছে, অর্থ লেনদেনের বড় অংশ করা হয়েছে নগদে বা ব্যাংকের বাইরে। পরে সেই টাকা বিভিন্ন উপায়ে পাচার করা হয় বিদেশে।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে গত ১২ মার্চ দুদক আরেকটি বড় মামলায় মালয়েশিয়ায় মানবপাচার ও শ্রমিক পাঠানোর নামে প্রায় ১ হাজার ১২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। আসামিদের মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও তার পরিবারের নাম উঠে আসে। এছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী ও সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠানও সেখানে অভিযুক্ত হয়।
সেই মামলায় ওভারসিজ কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকসহ মোট ৩৩ জনের বিরুদ্ধে ১২টি পৃথক মামলা হয়েছিল। এই মামলা এখনো তদন্তাধীন রয়েছে। আজকের ১৩টি মামলা যোগ হওয়ায় মালয়েশিয়া গমনকারী শ্রমিকদের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় মোট মামলা দাঁড়াল ২৫টিতে। আসামির সংখ্যা ৬৪ জন এবং মোট আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৮৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকার বেশি।
মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক হাজারো শ্রমিক এই চক্রের হাতে প্রতারিত হয়েছেন। অনেকেই কৃষিজমি বিক্রি, গবাদিপশু বিক্রি বা ঋণ করে টাকা জোগাড় করেছিলেন বিদেশে যাওয়ার আশায়। কিন্তু বাস্তবে তাদের অনেকেই নির্ধারিত সময়ে ভিসা বা চাকরির সুযোগ পাননি। ফলে ঋণের বোঝা, সামাজিক লজ্জা ও আর্থিক ভোগান্তি নিয়ে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের এক শ্রমিক অভিযোগ করেন, “আমরা শুনেছিলাম ৭৯ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া যাওয়া যাবে। কিন্তু এজেন্সি আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকা। এত টাকা জোগাড় করতে আমাকে জমি বিক্রি করতে হয়েছে। কিন্তু এখনও হাতে ভিসা আসেনি। টাকা ফেরতও দিচ্ছে না।”
প্রবাসী কল্যাণ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের দুর্নীতি কেবল শ্রমিকদের ক্ষতি করছে না, বরং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও ক্ষুণ্ন করছে। মালয়েশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজারে এই প্রতারণা প্রকাশ পাওয়ায় ভবিষ্যতে চুক্তি নবায়ন বা নতুন সুযোগ সৃষ্টিতে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
দুদক বলেছে, এসব মামলার তদন্তে কোনো প্রভাব খাটানো হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অভিযোগপত্র দাখিলের প্রক্রিয়া শুরু করবেন।
সর্বোপরি, মালয়েশিয়া প্রবাসের স্বপ্ন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের আশার আলো জাগিয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, মামলার পাশাপাশি দ্রুত বিচার ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের আর্থিক পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নিতে না পারলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ