
ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে দেশের জাতীয় দল। সেই পথচলার শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৭ সালে, যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সুনির্দিষ্ট কাঠামোর বাইরেও এক অসীম সম্ভাবনার নাম হয়ে উঠেছিল ‘বাংলাদেশ’। তখনকার মাঠের গল্প আর আজকের আধুনিক ক্রিকেট বাস্তবতা এক নয়, কিন্তু সেসব গল্পেই ভিত্তি গড়ে উঠেছিল একটি জাতির ক্রীড়াপরিচয়ের। সেই ধারাবাহিকতায় আজ বাংলাদেশের ওয়ানডে দলে সংযোজন হলো আরও একটি নাম—মেহেদি হাসান মিরাজ। ওয়ানডে ফরম্যাটে তিন ফরম্যাটে অভিষেক হওয়ার অনেক আগেই যাঁর পথচলা শুরু হয় বয়সভিত্তিক দলে। আজ তিনি দেশের ১৭তম ওয়ানডে অধিনায়ক।
শামিম কবির থেকে শুরু
১৯৭৭ সালের ৭ জানুয়ারি ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে (বর্তমান মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম নয়, তখনকার ঢাকা স্টেডিয়াম) ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)-র বিপক্ষে তিন দিনের একটি ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ। এটি ছিল দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে ‘বাংলাদেশ’ নামে প্রথম আনুষ্ঠানিক ম্যাচ খেলা। সেই ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছিলেন শামিম কবির। তাকে তাই বিবেচনা করা হয় বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেট অধিনায়ক হিসেবে।
মাঠে সেই ম্যাচটি জেতা না গেলেও, বাংলাদেশের ক্রিকেট তখনই সেদিন জিতে যায়—দর্শকের বিপুল আগ্রহ, ক্রিকেটারদের লড়াকু মনোভাব ও শৃঙ্খলার কারণে। ওই সফরের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ একই বছর জুন মাসে আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যা ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রবেশের প্রথম দরজা।
আন্তর্জাতিক যাত্রা ও ওয়ানডের জন্ম
বাংলাদেশ প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ১৯৮৬ সালে গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে। সেটা ছিল এশিয়া কাপের অংশ হিসেবে খেলা। এরপর কেটে গেছে চার দশকেরও বেশি সময়। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ দেখেছে সফল ও ব্যর্থ উভয় ধরনের অধিনায়ক, দেখেছে নেতৃত্বের উদ্ভব ও পতন, আবার দেখেছে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের গল্পও।
ওয়ানডে ফরম্যাটে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক হলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, যিনি ৮৮টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে জিতেছেন ৬০টি। তাঁর পর আছেন হাবিবুল বাশার (২৯ জয়), সাকিব আল হাসান (২৭ জয়) এবং তামিম ইকবাল (২১ জয়)। এসব নামের পাশে রয়েছে একাধিক অধিনায়ক যাঁরা হয়তো সাফল্য এনে দিতে পারেননি, কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের পথচলায় অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছেন।
ইনজুরিতে শান্ত, অধিনায়ক হলেন মিরাজ
এবারের শ্রীলঙ্কা সফরকে সামনে রেখে অধিনায়ক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিলেন নিয়মিত নেতৃত্বে থাকা নাজমুল হোসেন শান্ত। কিন্তু তাঁর চোট থাকায় আপৎকালীন অধিনায়ক হিসেবে মেহেদি হাসান মিরাজ-এর ওপর ভরসা রাখে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। যদিও তিনি আগেও চারটি ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব করেছেন, তবে এবারই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে অধিনায়কত্ব পেলেন, যা তাঁকে দেশের ১৭তম ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে দিল।
মিরাজের অধীনে এখন পর্যন্ত চারটি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ, তবে তার সবকটিতেই দল পরাজিত হয়েছে। যদিও পরাজয়ের চাপে মিরাজের নেতৃত্বগুণ পরখ করে দেখার সময় ছিল সংক্ষিপ্ত, তবুও এই দায়িত্ব তাঁকে একটি নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি করল।
১৭ অধিনায়কের তালিকায় কারা আছেন?
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওয়ানডে ইতিহাসে মোট ১৭ জন খেলোয়াড় অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়েছেন। নিচে তাদের তালিকা এবং পরিসংখ্যান দেওয়া হলো:
নাম | ম্যাচ | জয় | পরাজয় |
---|---|---|---|
মাশরাফি বিন মুর্তজা | ৮৮ | ৬০ | ৩৪ |
হাবিবুল বাশার | ৬৯ | ২৯ | ৪০ |
সাকিব আল হাসান | ৬২ | ২৭ | ৩৪ |
মোহাম্মদ আশরাফুল | ৩৮ | ৮ | ৩০ |
মুশফিকুর রহিম | ৩৭ | ১১ | ২৪ |
তামিম ইকবাল | ৩৭ | ২১ | ১৪ |
খালেদ মাসুদ পাইলট | ৩০ | ৪ | ২৪ |
আমিনুল ইসলাম বুলবুল | ১৬ | ২ | ১৪ |
আকরাম খান | ১৫ | ১ | ১৪ |
খালেদ মাহমুদ | ১৫ | ০ | ১৫ |
নাজমুল হোসেন শান্ত | ১৩ | ৪ | ৯ |
গাজী আশরাফ হোসেন লিপু | ৭ | ০ | ৭ |
লিটন কুমার দাস | ৭ | ৩ | ৩ |
মেহেদি হাসান মিরাজ | ৪ | ০ | ৪ |
নাঈমুর রহমান দুর্জয় | ৪ | ০ | ৪ |
মিনহাজুল আবেদীন নান্নু | ২ | ০ | ২ |
রাজিন সালেহ | ২ | ০ | ২ |
ভবিষ্যতের দায়িত্ব ও প্রত্যাশা
মেহেদি হাসান মিরাজের সামনে এখন কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। শান্তের অনুপস্থিতিতে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি নিজেও ফর্মে ফিরতে হবে। তরুণ এই অলরাউন্ডারের কাঁধে দায়িত্ব এখন শুধু একাদশে পারফর্ম করাই নয়, বরং গোটা দলকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের পথচলায় নেতৃত্বের পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। তবে প্রত্যেক অধিনায়কের হাত ধরে বদলে গেছে দল, বদলেছে ক্রিকেটের ধরণ। এখন দেখার পালা, মিরাজ কেমন নেতৃত্ব দেন, এবং নিজের অধ্যায় কিভাবে রচনা করেন জাতীয় দলের অধিনায়কত্বের ইতিহাসে।
একটা সময় বাংলাদেশ খেলতে পারে কি না, সেটি ছিল প্রশ্ন। আজ সে দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাঁড়িয়ে আছে গর্বের সঙ্গে, ১৭ জন অধিনায়কের হাত ধরে। এখন সেই মিছিলে নতুন নাম—মেহেদি হাসান মিরাজ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ