
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চরমে। সম্প্রতি ইসরায়েল ইরানের অভ্যন্তরে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে ভয়াবহ বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)-এর প্রধান হোসেইন সালামিসহ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ দুইজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। পরিস্থিতি এতটাই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বিষয়ে আলোচনা করতে হোয়াইট হাউসে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (NSC) জরুরি বৈঠক ডেকেছেন।
হোয়াইট হাউসের এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প ইরানে ইসরায়েলের চালানো সামরিক অভিযানের বিষয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য শুক্রবার সকাল ১১টায় ওয়াশিংটন ডিসিতে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেছেন।”
উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছিল। তবে চলমান হামলাকে ২০২০ সালের পর সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকেরা।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই হামলা তারা ‘আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই’ চালাতে বাধ্য হয়েছে।
তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, “ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনার পর হলেও এটি সম্পূর্ণভাবে একটি স্বতন্ত্র ইসরায়েলি সিদ্ধান্ত।”
ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থাগুলোর বরাতে জানা যায়, ইসরায়েলি হামলায় সরাসরি নিহত হন ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC)-এর সর্বাধিনায়ক হোসেইন সালামি। তিনি ছিলেন ইরানের বিপ্লবী বাহিনীর দীর্ঘ সময়ের চৌকস কমান্ডার এবং পারমাণবিক কর্মসূচির নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।
এছাড়া ইরানের দুইজন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীও এই হামলায় নিহত হয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে নাতাঞ্জ এবং ফোরদু পারমাণবিক স্থাপনার গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। নাম প্রকাশ না করা হলেও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মতে, এই দুই বিজ্ঞানীর মৃত্যু ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে বড় ধাক্কা তৈরি করতে পারে।
ইসরায়েলের এই একতরফা পদক্ষেপে মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন মার্কিন প্রশাসনের কূটনৈতিক কর্মকর্তারা। ট্রাম্প প্রশাসনের একাধিক সিনিয়র নিরাপত্তা উপদেষ্টা মনে করছেন, এই হামলা ভবিষ্যতে মার্কিন ঘাঁটি ও মিত্র রাষ্ট্রগুলোর ওপর পাল্টা আক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
তবে হোয়াইট হাউস স্পষ্ট করে জানায়নি, যুক্তরাষ্ট্র হামলার বিষয়ে আগে থেকে অবগত ছিল কিনা বা তারা সম্মতি দিয়েছে কি না। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, “আমরা ইরানের আগ্রাসন রুখতে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের মিত্রদের পাশে আছি, তবে কোনো একতরফা সামরিক অভিযানে আমরা সরাসরি অংশ নেই।”
ইরানের ওপর এই হামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
রাশিয়া এবং চীন হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই হামলাকে “অতিমাত্রায় উত্তেজনাকর ও বিপজ্জনক” আখ্যা দিয়ে দুই পক্ষকে ‘তাত্ক্ষণিক সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “ইসরায়েল যেসব অপরাধ করেছে তার প্রতিশোধ নেওয়া আমাদের অধিকার। রক্তের বদলে রক্তই হবে আমাদের জবাব।”
ইরানি সামরিক বাহিনীও সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে চলে গেছে বলে জানা গেছে। তেহরানের রাস্তায় লাখো মানুষ জড়ো হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেছে। ‘মার্কিন মদদে ইসরায়েলি আগ্রাসন’—এই স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠেছে ইরানের রাজধানী।
ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সাম্প্রতিক এই হামলা। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা, মধ্যপ্রাচ্যকে আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববাসীর নজর এখন হোয়াইট হাউস, তেহরান ও তেল আবিবের পরবর্তী সিদ্ধান্তের দিকে। যুদ্ধ হবে, না কূটনীতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবে—তা নির্ভর করছে পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যেই গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ